মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী!

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনাগুলো আলোচনায় উঠে এসেছে৷ উঠেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লংঙ্ঘন বন্ধের দাবি৷

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে এই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩৪৪ জন৷ ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩১৫টি৷

চলতি বছরের ১০ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন ১২ জন৷ তাদের মধ্যে পাঁচজন ফিরে এসেছেন৷ ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত ৩৫৪ জন গুম হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে লাশ উদ্ধার হয়েছে ৪৪ জনের আর ৬০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৪২ জন ফিরে এসেছেন৷ বাকিরা এখনো নিখোঁজ৷ এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ বাহিনী-র‌্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়ার অভিযোগ আছে৷ এছাড়া গত ১০ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছে ৫২ জন৷

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চলতি বছরে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনাকে প্রাধান্য পেয়েছে৷ এর সঙ্গে বাকস্বাধীনতা, বিরোধী দল, নাগরিকদের প্রতিবাদ ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা, মামলার কথা বলা হয়েছে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বেআইনি কাজে প্রায় ক্ষেত্রেই দায়মুক্তি পেয়েছে৷ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম-নিখোঁজের ব্যাপারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন বেড়েছে৷ সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীতার ওপরও নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷

এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আসক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধের দাবি জানিয়েছে৷ একইসঙ্গে তারা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে৷

আসকের নিবাহী পরিচালক শিপা হাফিজ বলেন, ‘‘আমরা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমকে প্রাধান্য দিচ্ছি৷ যখন কেউ গুম হয়, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলে তারা জানে না৷ কেউ কেউ যখন ফিরে আসে, তখন তারা বলে, ‘আমরা তাকে চোখে চোখে রাখছিলাম৷’ আবার যারা নিয়ে যায়, তাদের পরনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক থাকে৷ পুরো বিষয়টি রাষ্ট্রকে দেখতে হবে৷ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখন নানা নামে হচ্ছে৷ কখনো বন্দুকযুদ্ধ, কখনো এনকাউন্টার বা অন্য কোনো নাম দেয়া হয়৷”

তিনি বলেন, ‘‘তারা অপরাধী হোক বা না হোক, কোনো তথ্যের ভিত্তিতে যদি তাদের আটক বা অভিযান চালানো হয়, তাহলে প্রিকশান নেয়া হয় না কেন? তাহলে কি বন্দুকযুদ্ধের নামে কোনো কিছু গোপন করা হচ্ছে? আমরা তাই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এইসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা স্বাধীন কমিশন করে তদন্তের দাবি করছি৷”

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতেই কি এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি? পরিসংখ্যান কী বলে? মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকরা নিরাপদ থাকার কথা৷ কিন্তু সেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছেই যখন নাগরিকরা নিরাপদ থাকে না, তখন সেটা অনেক বেশি ভয়ের ব্যাপার৷ আর সে কারণেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে এত উদ্বেগ৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘সাধারণ অপরাধের তুলনায় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কম নয়৷ আর যারা নাগরিকদের রক্ষা করবে, তারাই এসব ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে৷ রাষ্ট্র দীঘদিন ধরে নীরব ভূমিকা পালন করছে৷ তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন করছে না৷ ফলে এটা অনেক বেশি ভয় আর আতঙ্ক তৈরি করছে৷”

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দাবি, তারাই স্বাধীন কমিশন৷ তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো দেখছে৷ কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য এবং সাবেক সিনিয়র সাচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি খুন , গুম, বিচার বহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা সরকারের সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে৷ আমরা কোনোভাবেই এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মেনে নিতে পারি না৷”

তিনি বলেন, ‘‘তবে দেশে আইন আছে, বিচারব্যবস্থা আছে৷ ভিকটিমকে সেখানে যেতে হবে৷ সেখানে যদি প্রতিকার না পান, তাহলে আমরা দেখবো৷”

তিনি জানান, ‘‘আমাদের কাছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আসছে৷ তারা যে লঙ্ঘন করছে না, তা আমি বলবো না৷ আমরা তদন্ত করে দেখছি৷”

এসএইচ-০৯/১২/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)