দেশের অগ্রগতিতে বুদ্ধিজীবীরা তাদের ভূমিকা রাখছেন না!

ক্ষমতার সঙ্গে যোগসূত্র থাকায় বাংলাদেশে অনেক বুদ্ধিজীবী তাদের ভূমিকা পালন করছেন না৷ তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা দেশের অগ্রগতি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে বলে মত অনেক তরুণ ও প্রবীণ চিন্তাবিদের৷

বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে শক্তিশালী ও স্বাধীন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছিল তা প্রায় নেই৷ কেউ বিপদে পড়ার, কেউ আবার সুযোগ সুবিধা হারানোর ভয়ে চুপ থাকেন৷ সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা কোনো কথা বলেন না৷ আবার যারা বলেন তারা দলীয় চিন্তার বাইরে যেতে পারেন না৷ সরকারের প্রয়োজনীয় সমালোচনাও তারা করেন না৷ তাদের কাছ থেকে কোনো দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বুদ্ধিজীবীদের কথা জানি সেই মানের ও চিন্তার বুদ্ধিজীবী ব্যতিক্রম ছাড়া আর নেই৷ নব্বই পর্যন্ত আমরা দলীয় বুদ্ধিজীবী দেখেছি৷ একদল অন্যায় করলে অন্যদলের বুদ্ধিজীবীরা কথা বলতেন৷ কিন্তু এখন কেউই কথা বলেন না, সবাই চুপচাপ হয়ে গেছেন৷ এর ফলে আমাদের প্রজন্ম চুপচাপ থাকাকেই স্বাভাবিক মনে করছে৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে৷’’

তাঁর মতে, ‘‘এই অবস্থা দেশের জন্য ভয়াবহ৷ দেশের অগ্রগতি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দেয় বুদ্ধিজীবীদের এই নিস্ক্রিয়তা৷’’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন প্রশ্নহীন হয়ে পড়েছেন৷ তারা মনে করেন সব কিছু সেটেল হয়ে গেছে৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হলো মুক্তির প্রশ্ন৷ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু মুক্তির প্রশ্ন সেটেল হয়নি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘দেশের মানুষের যে অবস্থা, গণতন্ত্রের যে অবস্থা, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তা অর্জিত হয়নি৷ কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা এসব বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন৷ তাদের অধিকাংশ সরকার ও শাসন ব্যবস্থার সংকট নিয়েও কোনো কথা বলছেন না৷’’

এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এর দুইটি দিক আছে৷ প্রথমত ধর্মীয় বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে এখানে এক ধরনের ডিলেমা আছে৷ তাই ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা এসব নিয়ে তারা কথা বলতে ভয় পান৷ আর তারা যেসব অন্যায্য সুযোগ সুবিধা পান তা হারনোর ভয়েও চুপচাপ থাকেন৷’’

আর তরুন সাংবাদিক ও লেখক বাধন অধিকারী মনে করেন, বুদ্ধিজীবী হবেন নিঃসঙ্গ৷ তারা যেকোনো শক্তি বা ক্ষমতার বাইরে থাকবেন৷ তারা ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন৷ আমরা একাত্তরে এই বুদ্ধিজীবীদের দেখেছি৷ তারা ছিলেন জনমুখী৷ কিন্তু এখনকার বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন৷

তিনি বলেন, ‘‘এই কারণেই আমরা বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছি৷ আমরা সামগ্রিক একটা ভয়ঙ্কর নীরবতা লক্ষ্য করছি৷ কোনো অন্যায় বা অপকর্মের বিরুদ্ধে আমরা স্পষ্ট ও সোচ্চার কোনো প্রতিবাদ এখন দেখি না৷ এটা বুদ্ধিজীবীদের নিরবতার কারণেই হয়েছে৷’’

এইসব মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে একাত্তরপূর্ব বুদ্ধিজীবী যাদের আমরা একাত্তরে হারিয়েছি তাদের সমমানের বুদ্ধিজীবী এখন আর নেই বললেই চলে৷ যারা সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী তারা কোনো বিষয়ে কোনো অবস্থান গ্রহণ করেন না৷ যেমন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখেই একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে আছে৷ এ নিয়ে কোনো বুদ্ধিজীবী কথা বলেন না৷ এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে৷’’

তিনি মনে করেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা এবং ব্যক্তিআকাঙ্খা বড় হয়ে যাওয়ার কারণে এটা হয়েছে৷ বলেন, ‘‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি৷ কিন্তু রাষ্ট্র স্বাধীন হয়নি এখনও৷ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হলে আমাদের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি দরকার৷ সরকার ভালো কাজ করছে৷ কিন্তু অনেক প্রশ্নবিদ্ধ কাজও করছে৷ এ নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সোচ্চার হওয়া দরকার৷’’

এসএইচ-০৮/১৫/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)