প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যত প্রশ্ন?

দেশের রাজধানী ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীরা এখন জনসংযোগে ব্যস্ত। এসময় দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। যদিও প্রার্থীরা এখনো তাদের আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেননি।

প্রার্থীদের অনেকে তাদের প্রচারের সময় যেসব প্রতিশ্রতি দিচ্ছেন সেগুলো হচ্ছে – ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ডিজিটাল পরিবহন ব্যবস্থা, নিরাপদ শহর গড়ে তোলা, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, নগর পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো – ইত্যাদি বিষয়।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মেয়র প্রার্থীদের কেউ-কেউ এমন প্রতিশ্রতি দিচ্ছেন যেগুলো আইন অনুযায়ী তাদের দায়িত্বের মাঝে পড়েনা। তাছাড়া এসব কাজ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা রয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, একই কাজ করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের যে দায়িত্ব রয়েছে, সরকারের অন্য সংস্থাকেও সে দায়িত্ব দেয়া আছে।

সিটি কর্পোরেশন আসলে কী করতে পারে আর কী করতে পারেনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন বিভিন্ন সময় উঠেছে। কিন্তু আইন কী বলছে?

সিটি কর্পোরেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে তফসিল রয়েছে সেটির ১৯.১ ধারায় বলা হয়েছে, জনগণ যাতে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে সেজন্য সিটি কর্পোরেশন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

কিন্তু সিটি কর্পোরেশন যে ধরনের যানবাহনের লাইসেন্স দেয় কিংবা নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো হচ্ছে অযান্ত্রিক বাহন। কিন্তু বাস, ট্রাক, মোটর সাইকেল – এসব বাহন নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের।

তবে সরকারের অনুমতি নিয়ে যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবে সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু অতীতে কখনোই সিটি কর্পোরেশন এটি নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

ভাড়া নির্ধারণ করার বিষয়টি সবসময় এসেছে পাবলিক বাসের ক্ষেত্রে। বিআরটিএ মালিকদের সাথে আলোচনা করে এ কাজ করেছে সবসময়। এখানে সিটি কর্পোরেশনের কোন ভূমিকা দেখা যায়নি।

তাছাড়া সরকার নির্ধারিত ভাড়া বাস মালিকরা কখনোই মানেনি এবং এজন্য কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।

রাস্তা মেরামত করার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। আইন অনুযায়ী রাস্তার উপর তাদের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে। এছাড়া ফুটপাত সিটি কর্পোরেশনের সম্পদ।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, “ফুটপাত রক্ষা করা এবং ফুটপাতে মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করা সিটি কর্পোরেশনের একটি বড় কাজ। একাজ করতে অন্য কারো অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই।”

সিটি কর্পোরেশন কার্যাবলীর ১২ এবং ১৩ নং ধারায় বলা আছে, অনুমতি ছাড়া যেখানে-সেখানে বাজার বসানো যাবেনা। সিটি কর্পোরেশনের কাজের মধ্যে এটি নির্ধারণ করে দেয়া আছে।

সিটি কর্পোরেশন কার্যাবলীর তফসিলে ৮.১ ধারায় বলা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন নগরীতে সাধারণ এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করবে।

নিরাপদ পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের এখতিয়ার আছে। কিন্তু পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কোন অবকাঠামো নেই। ঢাকা শহরের পানি সরবরাহের কাজটি করে ঢাকা ওয়াসা।

পয়:নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব আছে।

সিটি কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই সমন্বয় নিয়মিত হয়না বলেই ব্যাপক অভিযোগ আছে।

প্রার্থীদের অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে তারা নির্বাচিত হলে নিরাপদ নগরী গড়ে তুলবেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, আইন অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে পুলিশ। তারা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে নয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, “কর্পোরেশনের কাজের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা নিরাপদ করার বিষয়টি আমি কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা।”

ঢাকা শহরের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক।

যে কোন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের অনুমোদন নিতে হয়। ভবন নির্মাণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কোন ভূমিকা নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবন নির্মাণের সময় সিটি কর্পোরেশনের কোন নজরদারি দেখা যায়না। কিন্তু নির্মাণ হবার পরে সিটি কর্পোরেশন পৌর কর নেয়।

আইন অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনের জন্য যেসব কাজ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেসব কাজ করার জন্য সরকারের আরো কিছু সংস্থাকেও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন কতটুকু করবে আর অন্য সংস্থা কতটুকু করবে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, “সাধারণত সিটি কর্পোরেশন যেসব কাজ করে আসছে, সেগুলোর বাইরে তারা যায়না বা যাবার সুযোগ কম।”

সিটি কর্পোরেশন কিভাবে কাজ করবে এবং সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কী হবে তারা বর্ণনা করা আছে আইনের ৪১ নং ধারায়।

সিটি কর্পোরেশনের কাজের জন্য মেয়র এবং কাউন্সিলরগণ যৌথভাবে দায়ী থাকবে।

“সিটি কর্পোরেশন একটি কর্পোরেট বডি। এখানে অনেক কাউন্সিলর নির্বাচিত হচ্ছেন। কাউন্সিলরদের নিয়েই কর্পোরেশন। আইন অনুযায়ী মেয়র একক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা।”

“কিন্তু এখন আমরা সিটি কর্পোরেশনকে এমনভাবে তুলে ধরছি, যেন মেয়রই সবকিছু করে।”

তিনি বলেন, কাউন্সিল সভার আগে যদি কোন কাজ করার প্রয়োজন হয়, তাহলে মেয়র সেটি করতে পারেন। কিন্তু পরবর্তীতে কাউন্সিল সভায় সেটি অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।

অনেক সময় সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার সিটি কর্পোরেশনকে বড় আকারের বাজেট বরাদ্দ দেয়। আইন অনুযায়ী সেটি নির্ধারণ করা আছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মেয়রের ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর নির্ভর করে অন্যান্য সংস্থার সাথে তিনি কতটা সমন্বয় করতে পারছেন।

এসএইচ-০৪/১২/২০ (আকবর হোসেন, বিবিসি)