আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছে মানুষ?

দেশে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকার দু’টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা এবং বিশ্লেষণ চলছে।

নির্বাচন নিয়ে ভোটারের আস্থার অভাবকে অন্যতম একটি কারণ হিসাবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা।

কিন্তু প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে যারা চিরকাল সমর্থন দিয়ে এসেছেন – তারাও কেন এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এই প্রশ্ন করছেন অনেকেই।

দল দু’টি কি পরিস্থিতিকে আমলে নিয়েছে? এই সংকট থেকে বেরুনো কি সম্ভব হবে? এসব প্রশ্নই এখন রাজনীতির আলোচনায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

ঢাকার দু’টি সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখের বেশি। কিন্তু নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে দেখা গেছে খুব কম লোককেই।

নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশেরও কম।

এই পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন কারণ তুলে ধরছে রাজনৈতিক দলগুলো ।

তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলো বিষয়টি দেখছেন ভিন্নভাবে। বেসরকারি সংগঠন ফেমার প্রধান মুনিরা খান বলছেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সমর্থকরা এবার ভোট দিতে যাননি।

“ভোটারদের এই যে অনাস্থা, এর দায় নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোও প্রার্থী দিয়েছে, তাদের কি ভূমিকা ছিল? তারা আর কিছু করতে না পারুক, তারাতো ভোটারদের কাছে গিয়ে উৎসাহিত করতে পারতো। তাহলেও তো গণতন্ত্রের জন্য একটা কাজ হতো।”

মিজ খান আরও বলেছেন, “একটা জিনিস খেয়াল করবেন, বড় দুই দলেরই প্রচারণায় কিন্তু প্রচুর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পোস্টারের ছড়াছড়ি ছিল। কেউ কিন্তু কারও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেনি। তারপরও ভোট দিতে তারা আসলো না।”

“ভোটব্যাংক যাদের ছিল, পার্টিগুলোর সেই ভোটাররা কেন আসলো না? এটা সত্যি গবেষণার দাবি রাখে” – বলেন মুনিরা খান।

ঢাকায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জিতেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরাই।

কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার দুই সিটির ভোটার সংখ্যার বিচারে দলটি পেয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ ভোট।

যেখানে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোটার ৪০ শতাংশের বেশি বলে এই দলের নেতারা দাবি করেন – কিন্তু ভোটের বিশ্লেষণে বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ভোটাররাও ভোট দিতে আসার প্রয়োজন অনুভব করেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের দলের মধ্যম সারির নেতাদের অনেকে বলছেন, ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের প্রার্থী জিতে যাবে, এমন একটা ধারণা তাদের ভোটারদের মাঝেও তৈরি হয়েছিল। তারা মনে করেন, এটিও নির্বাচন নিয়ে একটা নেতিবাচক বার্তা দেয়।

তবে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, শুরু থেকেই বিরোধীদল এই নির্বাচন নিয়ে একটা নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছিল, এরসাথে আরও অনেক কারণ রয়েছে। তবে তোফায়েল আহমেদ এটাও বলেছেন যে তাদের দল পরিস্থিতিকে আমলে নিচ্ছে।

“আওয়ামী লীগের মধ্যে তো এই রিয়েলাইজেশন আছেই যে, আমাদের নিজেদের ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যায়নি। আবার বিএনপির যারা ভোটার তারাও ভোটকেন্দ্রে যায়নি।”

আহমেদ বলেন, এর অনেকগুলো কারণ ছিল। “প্রথমত ভোটের সময় লম্বা ছুটি পড়েছিল। তারপর শুরু থেকেই মানুষের মাঝে ইভিএম নিয়ে একটা ভুল বার্তা দিয়েছিল বিএনপি।”

“বিএনপির প্রচারণার কারণে মানুষ ধরেই নিয়েছিল, ইভিএমের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল অধিকাংশ ভোট নিয়ে নেবে, মানুষ ভোট দিতে পারবে না। এটা বিএনপি শুরু থেকেই তৈরি করেছিল। সব মিলিয়ে নির্বাচন নিয়েই একটা নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল।”

তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, সব দল যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে তাহলে এরকম পরিস্থিতি হওয়ার কথা নয়।

ঢাকায় বিএনপির প্রার্থীরাও ভোট অনেক কম পেয়েছেন।

পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, ঢাকার মোট ভোটারের মাত্র ৯ শতাংশ ভোট বিএনপি পেয়েছে।

যদিও দলটি অতীতের মতো এবারও তাদের প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা এবং ইভিএমে কারচুপির নানা অভিযোগ করেছে সরকারের বিরুদ্ধে।

কিন্তু এবার তিন সপ্তাহ ধরে নগরীর অলিগলিতে প্রচারণায় বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন। এছাড়া বিএনপির নেতারাও ৪০ শতাংশের বেশি তাদের ভোটব্যাংক বলে দাবি করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির মধ্যম সারির একাধিক নেতা বলেছেন, তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং নির্বাচন নিয়ে নানা ধরণের বক্তব্যে কারণে তাদের ভোটাররাও আস্থা পায়নি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য মনে করেন, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে তারা হেরে গেলেও রাজনৈতিকভাবে তাদের লাভ হয়েছে। এরপরও তারা নিজেদের দূর্বলতাগুলো বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

“এখানে সিস্টেমটাই একটা প্রতিকুল বা বৈরি অবস্থা তৈরি করেছে গণতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য। আমাদের পক্ষে তো মারামারি মারপিট করে সবসময় কিছু করা সম্ভব নয়।”

মি. আলমগীর বলেন, তাছাড়া বিএনপি গত ১০ বছরে যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সবমিলিয়ে একটা প্রচন্ড চাপতো আছেই। সেই চাপের মধ্যে থেকেও আমরা কিন্তু অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা সব নির্বাচনগুলোতে অংশ নিচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “আজকে এই চুরি-ডাকাতির মধ্যেও হিসাব করে দেখেন, বিএনপি কিন্তু কম ভোট পায়নি। যেটা পেয়েছে একেবারে নিরঙ্কুশভাবে পেয়েছে। এই ভোট সঠিকভাবে দেখানো হলে বিএনপি অনেক ভোটে জিতে যেতো।”

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সরকার বা দলগুলোর পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেছেন, এই নির্বাচনে ভোটার কম হওয়ার বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তারা পর্যালোচনা করছেন।

মিজ খানম মনে করছেন, একটি-দু’টি নয় – অনেকে কারণ রয়েছে এমন নির্বাচনের পিছনে।

“শুধু নির্বাচন কমিশন দায়ী, সেটা বলা যায় না। অথবা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়ী করা যায় না। অনেকগুলো পারিপাশ্বিক কারণ রয়েছে। যেগুলো অবশ্যই আমাদের চিহ্নিত করা উচিত।”

নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটার উপস্থিতি না থাকলে নির্বাচনে গণতন্ত্রের যে কথা বলা হয়, সেটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে।

কবিতা খানম আরও বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন আপাতদৃষ্টিতে যেটা মনে করে, সেটা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আস্থাহীনতার একটা অভিযোগ যে সবসময় করা হয়, সেটা ভোটারের মাঝে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

“ইভিএম নিয়ে অনেক নেতিবাচক আলোচনা হয়েছে। আমরা যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিলাম, এটারও একটা প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া ছুটি এবং এসএসসি পরীক্ষা সব মিলিয়ে প্রভাব পড়েছে বলে আমরা মনে করছি।”

নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটের কথা যখন আসছে, বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। সহসাই ভোটের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা-এই প্রশ্নও তুলছেন বিশ্লেষকরা।

এ ক্ষেত্রে এখনও আশাবাদী মুনিরা খান।

তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোকেই মুল ভূমিকা রাখতে হবে। “আমি মনে করি যে, এখনও ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেজন্য সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তারপর অন্য রাজনৈতিক দল এবং ভোটারদেরও সদিচ্ছা প্রয়োজন। কারণ ভোটারদেরও দায়িত্ব আছে।”

বিএনপির অনেক অভিযোগ রয়েছে এখনকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে। দলটি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির অভিযোগ করছে।

তবে সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়েছে, এমনটা মানতে রাজী নন বিএনপি নেতা আলমগীর।

“আমি কোনোদিনই মনে করি না যে, মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে বা কলাপস করেছে। পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু উঠে দাঁড়ায় এবং তার পথ নিজেরাই তৈরি করে নেয়।”

তিনি তাদের পুরোনো দাবি আবার সামনে আনলেন, “এখনই যদি তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া হয়, তাহলে মুহুর্তের মধ্যে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। নির্বাচনে কারচুপি বা অনিয়ম হবে না-এটা যখনই মানুষ বিশ্বাস করবে, তখনই সে নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে।”

বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার সময় তত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে জটিলতার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছিল।

২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান সংশোধন করে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। আবারও সেই তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পুরোনো বিতর্ক তোলা হচ্ছে।

নির্বাচন নিয়ে আস্থা ফেরানোর জন্য বিএনপি তাদের পুরোনো দাবির কথাই বলছে। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ নির্বাচন ইস্যুতে দলগুলোর ঐক্যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।

“আসলে জাতীয় কিছু ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে তো ১০ দল থাকলে ১০টা মত থাকে। আমরা একমতে আসতে পারি না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এই নির্বাচন ইস্যুতে ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।”

কিন্তু নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি যে তত্বাবধায়ক সরকার চায়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “তাহলে ঐক্যবদ্ধ কিছু হলো না। কারণ তত্বাবধায়ক সরকারওতো আপনি কলঙ্কিত করেছেন। বিএনপি যখন তাদের ইয়াজউদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে দিলো এবং যার জন্য ওয়ান ইলেভেন হলো।”

“এছাড়া ১৯৯৬ সালে যখন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো, তখনও আপনি আজকের মতো নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সুতরাং সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হবে।”

২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করেছে।

২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ সবদল অংশ নিলেও সেই নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ভোট নিয়ে আস্থার সংকটের ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপটকেই তুলে ধরছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

এরসাথে ভিন্নমত পোষণ করছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।

তিনি বলছিলেন, ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফেরত আসার পর থেকে এপর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, সব নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ফলে অতীতের কোনো প্রভাব এখন পড়েনি বলেই তারা মনে করছেন।

“প্রশ্ন কিন্তু আছে প্রত্যেকটা নির্বাচন নিয়ে। যে দল পরাজিত হয়, তারা কিন্তু সবসময় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকে। ফলে আগের কোনো নির্বাচনের কারণে এবার ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে, এটা আমি মনে করি না।”

ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “ভোটার উপস্থিতির বিষয়কে নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। সামনের দিনগুলোতে যাতে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে, সেখানে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা কমিশন করবে। অন্য পক্ষগুলোরও সবার সেখানে দায়িত্ব আছে।”

ঢাকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে এবং বিএনপিও মনে করছে তাদের এক ধরণের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে।

তবে ভোটাররা নির্বাচন-বিমুখ হওয়ার প্রসঙ্গে দুই দলের নেতারাই মনে করছেন, কোনো পক্ষেরই আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।

তারা মানুষের আস্থা ফেরাতে দলগুলোর ঐকমত্যের কথাও বলছেন। কিন্তু সহসাই এর সম্ভবনা নিয়ে দলগুলোর নেতারাই সন্দিহান।

এসএইচ-০৫/০৮/২০ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)