ব্যাংকের টাকা উজাড়, বেকাদায় সরকার

সরকারের গৃহিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ চাহিদা বাড়ছে। উন্নয়ন ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। অর্থ সংকট কাটাতে ঝুঁকতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎসের প্রতি। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতই অগ্রাধিকার পেয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষ হতে আরও পাঁচ মাস বাকি থাকলেও সরকার লক্ষ্যমাত্রার পুরো টাকার চেয়েও প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে ফেলেছে। মাত্র ৭ মাসে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও সরকারের বেশি টাকা নেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। সরকারের উচ্চ পরিমাণের ব্যাংকঋণ ব্যক্তি ও বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে তৈরি করেছে স্থবীরতা।

এক দিকে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ নিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাত পাচ্ছে সবচেয়ে কম ঋণ। খেলাপি ঋণও নিয়ন্ত্রণে নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন খাত শ্লথ হয়ে পড়ায় সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর—সব ক্ষেত্রেই আদায় কম। আয় কমে যাওয়ায় এখন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সরকারের হাতে আছে একগুচ্ছ বৃহৎ প্রকল্প, আছে দৈনন্দিন খরচ। বছরের পর বছর ধরে চলা এসব প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়াচ্ছে সরকার। সব মিলিয়ে সরকার পরিচালনায় ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ব্যয়ের খাত বড় হলেও আয়ে রয়ে গেছে বড় ঘাটতি।বাড়েনি রাজস্ব আদায়ের পরিধি।

বর্তমানে ১১টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা আছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। বেশির ভাগ বড় প্রকল্পেই খরচ ও বাস্তবায়নের সময় বেড়েছে। এতে এর অর্থনৈতিক উপযোগিতাও কমছে। আবার সরকার এখন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তার তুলনায় স্থানীয় উৎস থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করছে। এই অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। ফলে প্রকল্পে একেকটি বালিশের দাম পড়ছে ৬ হাজার টাকা, চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বই কেনা হচ্ছে ৮৫ হাজার টাকায়, আর পর্দার দাম হয়ে যাচ্ছে ৩৭ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরের (২০১৮-২০১৯) জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত (৭ মাসে) সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছিল মাত্র ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৫২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। এই টাকার পরিমাণ গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণ নিয়েছিল, তারচেয়েও ২৯ হাজার কোটি টাকা বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে , সরকারের নেওয়া ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকার মধ্যে ৪৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকাই নিয়েছে বেসরকারি ব্যাংক থেকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৮ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরের। তবে ওই অর্থবছরে ধার নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অথচ এই অর্থবছরের সাত মাসেই পুরো অর্থবছরের টাকা নেওয়া শেষ করেছে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযাযী, ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের চেয়ে সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ২৭ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে এখন ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। আর সরকারি খাতে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৯ দশমিক ৮১ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

এদিকে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ ধরে কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয় তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। আগের বছরও যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আদায় অর্ধেক কমে গেলেও সরকার ব্যয় বাড়ছে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে। ব্যয়ভার সামলাতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকখাত থেকে সরকার যখন বেশি ঋণ নেয়, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বা শিল্পকারখানা গড়তে ব্যাংকগুলো তখন বেসরকারি খাতে তেমন ঋণ দিতে পারে না। এটা জেনেও নগদ টাকার সংকট মেটাতে সরকার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভর করছে ব্যাংক খাতের ওপর।তবে ব্যাংকে অর্থ থাকলেই যে বেসরকারি খাত ঋণ নেবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এ জন্য বিনিয়োগের পরিবেশ থাকাটা জরুরি। সরকার এখন মনে করছে, সুদের হার ৯ শতাংশ করলেই বিনিয়োগ বাড়বে। তবে ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় নয়, সরকারের নির্দেশে সুদহার কমাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া কেবল সুদহার কমালেই বিনিয়োগ হবে, এমন কোনো উদাহরণও কোথাও তৈরি হয়নি; বরং সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের এই বেশি মাত্রার ঋণ গোটা ব্যাংক খাতকেই সংকটে ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

চলমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের ঋণ নেওয়ার বর্তমান ধারাটি নজিরবিহীন, কারণ এ দেশের অর্থনীতি কখনও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।সরকারের ব্যাপক হারে ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকের তারল্য সংকট আরও বাড়বে এবং এটি শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাতকে ঝুঁকিতে ফেলবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাত চাহিদার তুলনায় কম ঋণ নিয়ে কাজ করছে এবং সরকারের উচ্চহারে ঋণ নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষের দিকে এই খাত থেকে নেওয়া ঋণের অংক দাঁড়াতে পারে প্রায় ১০০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে, চলতি অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার সীমা হচ্ছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।

আহসান এইচ মঞ্জুর বলেন, তিনি বলেন, সরকারের ঋণ বড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে বাধা সৃষ্টি হবে। তাই সরকারের ব্যাংক খাতের ঋণের ওপর না ঝুঁকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। আর যদি রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারে, তা হলে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। অর্থ সংকটের কারণে আশানুরূপ বাড়ছে না ব্যক্তি খাতে ঋণ। গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক কমছে।

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করছে। ১ টাকার কাজ ৫ টাকায় হচ্ছে। জনগণের সম্পদের স্বচ্ছ ব্যবহার করা গেলে এমনটি হতো না। এটা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটা বড় দুর্বলতা।

তিনি আরও বলেন, দেশীয় উৎস থেকে ঋণ করলে খরচের জবাবদিহি কম। বিদেশি ঋণে অনেক শর্ত থাকে। এ জন্য সরকার দেশীয় উৎসের দিকেই ঝুঁকছে। এতে দেশের ব্যবসায়ীদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ যেমন কমে আসছে, তেমনি করের বোঝা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপর পড়ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্ণর আরও বলেন, বড় প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকার এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর জের ধরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আগামীতে আরও বাড়বে। ফলশ্রুতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে, যা সাধারণ মানুষকে সংকটে ফেলবে।

এসএইচ-০৪/১৮/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : পূর্বপশ্চিম)