সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়ে জঙ্গিতে জড়াচ্ছে!

দেশে যারা গত কয়েক বছরে জাঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে তাদের ৮২ ভাগই ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিরা এখন এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ও নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে৷

এই নতুন পদ্ধতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সক্ষম নয় বলে মনে করেন জঙ্গিদের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত গবেষক তানভীর হাসান জোহা৷

অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)-এর অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান সোমবার ঢাকায় জঙ্গিবাদ নিয়ে এক সেমিনারে বলেন, ‘‘জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সন্দেহে আটক ২৫০ জনকে পর্যবেক্ষণে জানা যায়, তাদের মধ্যে ৮২ ভাগই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়িয়েছে৷ আর তাদের মধ্যে ৫৬ ভাগ সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে, ২২ ভাগ পড়াশোনা করেছে মাদ্রাসায়৷’’

তাদের মধ্যে ১২০ জনের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর আর ১১০ জনের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে৷

জঙ্গিরা এখন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এনক্রিপ্টেড মেসেজ অ্যাপ ব্যবহার করে৷ যাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে তাদেরই টার্গেট করা হয় রিক্রুটমেন্টের জন্য৷

মনিরুজ্জামান মঙ্গলবার বলেন, ‘‘হোলি আর্টিজান হামলার পর বিভিন্ন সময়ে আটক মোট ৫০০ জনকে নিয়ে এই গবেষণা করা হয়৷ তবে আমরা স্যাম্পলিং করি ২৫০ জনের৷ তাই রেফারেন্স হিসেবে ২৫০ জনের কথাই বলা হয়৷ বাকিদের ব্যাপারেও আমাদের পর্যবেক্ষণ একইরকম৷’’

তিনি জানান, ‘‘জঙ্গিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহারের প্রবণতা কমছে না৷ তারা রিক্রুটমেন্ট করছে৷ উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখছে৷ আমাদের মনিটরিং-এ তা স্পষ্ট৷ আর এটা বিশ্বব্যাপী একটা সমস্যা, শুধু আমাদের নয়৷’’

তথ্য প্রযুক্তিবিদ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিসনেস অ্যান্ড টেকনোলজির সহকারী অধ্যাপক তানভির হাসান জোহা বলেন, ‘‘২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখবো, জঙ্গি সংগঠনগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিন পর্যায়ে রিক্রুট করতো৷ প্রথমে তারা ফেসবুকে একটা পেজ চালাতো৷ সেখান থেকে বেছে বেছে কিছু লোককে ফেসবুক ক্লোজ গ্রুপে নিয়ে আসতো৷ সেখান থেকে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে নিয়ে এসে ব্লগার হত্যাসহ আরো অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতো৷ তখন কনফিডেনশিয়াল গ্রুপ হিসেবে হোয়াটস অ্যাপ ছিল৷’’

কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বেড়ে যাওয়া জঙ্গিরা ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপে তাদের গোপনীয়তা রাখতে ব্যর্থ হয়৷ ধরা পড়া শুরু করে৷ তখন তারা টেলিগ্রাম ও সিগন্যাল ব্যবহার শুরু করলো৷ এই দু’টি অ্যাপস-এ সক্রিয়দের চিহ্নিত করতে পারে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ একমাত্র উপায় হচ্ছে কোনো জঙ্গির আইডির ভিতরে ঢুকে দেখা৷ সেটা প্রায় অসম্ভব বলে জানান এই তথ্য-প্রযুক্তিবিদ৷

তিনি জানান, ‘‘এখন আল কায়েদা এবং আইএস ভাবাদর্শের যারা, তারা নির্দিষ্ট আইপিনির্ভর নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে৷ হোলি আর্টিজান হামলার সময় তারা নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেছে৷ তারা এগুলো নিজেরাই তৈরি করে৷ ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট আইপি থেকে ডাউনলোড করে নেয়৷’’

এইসব অ্যাপস-এর ডাটা এনক্রিপ্টেড (ইলেট্রনিক সিগন্যাল) থাকে৷ ফলে মাঝখান থেকে সেই তথ্য পড়ার কোনো সুযোগ থাকে না৷ আর এখনো বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সেই সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি বলে জানান তানভীর হাসান জোহা৷

তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন জঙ্গিরা তাদের রিক্রুটমেন্ট এবং অপারেশনে এই এনক্রিপ্টেড অ্যাপ এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পুরো বিশ্বের একটা সমস্যা৷’’ এটা মোকাবেলা করতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷

অ্যাডিশনাল ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ আরো যেসব ডিজিটাল মাধ্যম আছে, তার মনিটরিং জোরদার করেছি৷ জঙ্গিরা কোথায় কিভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে তা নজরদারিতে রেখেছি৷ তবে তরুণদের এই পথ থেকে দূরে রাখতে সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই৷ তাদের প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে৷ সামাজিক কর্মসূচি নিতে হবে৷ একই সঙ্গে হতাশা, অসাম্য, অর্থনেতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে৷’’

তিনি মনে করেন, ‘‘মূল কথা হচ্ছে সুশিক্ষা৷ এটা যদি আমরা তরুণদের দিতে পারি, তাহলে তাদের মিসগাইড করা সহজ হবে না৷’’

এসএইচ-০৪/১৯/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)