ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়!

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন আর বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়৷ বরং সরকারকে ঋণ দিয়ে নিরাপদ থাকতে চায় তারা৷ অন্যদিকে বাজেট ঘাটতির চাপ মেটাতে বেশি সুদের সঞ্চয়পত্রের বদলে ব্যাংকমুখী সরকারও৷

প্রতিবছর বাজেটে সরকার যে খরচের লক্ষ্যমাত্রা ধরে তার একটি অংশ ঘাটতি থাকে, যা মেটানো হয় দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে৷ চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল সরকার৷ এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেয়ার কথা ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছয় মাসেই ব্যাংক খাত থেকে মোট ঋণ নেয়া হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা৷ গণমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য বলছে, জানুয়ারিতে তা আরো বেড়ে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে৷ ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত তা ৫১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকায় ঠেকেছে৷

সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয় বেশ কয়েকটি উপায়ে৷ সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকেও ধার করে৷ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যার পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা৷ বাকি ৪১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকাই নেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে৷ এই টাকা সরকার নিয়েছে বাজারে ট্রেজারি বিল বা বন্ড ছেড়ে৷ ব্যাংক সেই ঋণপত্র কিনে সরকারকে টাকা দিয়েছে৷

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থমন্ত্রণালয় চাইলে তারা ঋণ দিতে বাধ্য৷ কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে কোনো বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে সরকার ঋণ নেয় না৷ ট্রেজারি বিলগুলো নিলাম হয়৷ যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেখানে অংশগ্রহণ করতে চায়, যেই রেট তারা দেয়, তার মধ্যে যে নিতে পারে সে নেয়৷ এখানে কোনো জোরজবরদস্তির ব্যাপার নেই৷’’

সাধারণত সরকারকে ঋণ দেয়ার চেয়েও বাণিজ্যিকভাবে ঋণ বিতরণ করেই ব্যাংকের বেশি লাভ হওয়ার কথা৷ তারপরও সরকারের ঋণপত্র কিনতে কেন এত আগ্রহী তারা? ড. জায়েদ বখত মনে করেন, ব্যাংকগুলো এখন তাদের ‘পোর্টফোলিও ডাইভারসিফাই’ করতে চায়৷ পাশাপাশি খেলাপি ঋণও এড়াতে চায় তারা৷ যার কারণে নয়ভাগে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণের চেয়ে সরকারের বন্ড কেনাই তাদের জন্য নিরাপদ৷

গত কয়েক বছর ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ক্রমান্বয়ে বেড়েছে৷ শিল্পখাতে ঋণ দিয়ে তা আদায়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে৷ আগের চেয়ে কিছুটা কমার পরও বিতরণকৃত ঋণের ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে ডিসেম্বর পর্যন্ত, যা মোট ঋণের নয় দশমিক তিন-দুই শতাংশ৷

অন্যদিকে সরকারি ঋণপত্র কিনলে ব্যাংকগুলো আগের চেয়েও বেশি হারে সুদ পাচ্ছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘ট্রেজারি বন্ডের সুদ হার প্রায় আট ভাগের উপরে চলে গেছে৷ সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জন্য সরকারি বিনিয়োগই এখন সবচেয়ে নিরাপদ৷ ’’

সবমিলিয়ে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ ৩৮ দশমিক চার-আট ভাগ বেড়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র তিন দশমিক চার ভাগ৷

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সরকার নিজেই এত ঋণ নেয়ার কারণে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাবে না বেসরকারি খাত৷ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘ব্যাংকের প্রধান কাজই হলো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করা৷ তারা আমানতকারীদের টাকা নেবেন সেই টাকা বিনিয়োগের জন্য বিতরণ করবেন৷ কিন্তু এখন তাদের প্রকৃত কাজটাই কমে যাবে৷ তারা অন্য উপায়ে আয়ের পথ খুঁজবেন, যেটা খুবই খারাপ ইঙ্গিত৷’’

তার এই পূর্বাভাস মিলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও৷ বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের গতি এরইমধ্যে কমে গেছে৷ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোটে সোয়া চার ভাগ, যেখানে আগের বছরের একই সময়েও এই হার ছিল সাড়ে পাঁচ ভাগের বেশি৷ তবে সরকারের ঋণ নেয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে তা মানতে নারাজ ড. জায়েদ বখত৷ তিনি বলেন, এত কিছুর পরও ব্যাংকে অলস অর্থ আছে৷ কিন্তু ব্যাংকগুলোর অতি সতর্কতার কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমে যাচ্ছে৷

‘‘বেসরকারি ব্যাংকই প্রাইভেট সেক্টরের (বেসরকারি খাতের) ঋণের সত্তর ভাগ বিতরণ করে৷ তারা যেহেতু অনেক সতর্কতার সাথে ঋণ দিচ্ছে সেকারণেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম,’’ বলেন তিনি৷

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকার তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরেছিল৷ এর মধ্যে প্রথম ছয় মাসে এনবিআরের এক লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা আদায়ের কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র এক লাখ পাঁচ হাজার ১৬১ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল৷

অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা বিক্রির লক্ষ্য ছিল সরকারের, সেখানে ছয় মাসে বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা৷

বাজেটের ঘাটতি মেটাতে তাই ব্যাংক খাতের ঋণে ঝুঁকেছে সরকার৷ অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত মনে করেন, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমাতে সরকার যে এতটা সফল হবে তা তারা বুঝতে পারেনি৷ বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে তার চেয়েও কম খরচে এখন তারা টাকা নিতে পারছে৷

তবে সরকারের এই আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে বলে মনে করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে একসাথে৷ সেগুলোর বেশরভাগই অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন থেকে হচ্ছে৷…অনেক প্রকল্প আছে যেগুলোর কোন প্রয়োজনই নেই৷ আর সেগুলোর খরচও বেড়ে যাচ্ছে প্রায়ই৷ প্রকল্পের কেনাকাটায় দুর্নীতি হচ্ছে৷ এগুলোর কোন নিয়ন্ত্রণ নাই৷’’ এসব কারণে সরকারের বাজেট ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা ঋণের চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেই মনে করেন ড. সালেহউদ্দিন৷

এসএইচ-১০/২৪/২০ (ফয়সাল শোভন, ডয়চে ভেলে)