মোবাইল কোর্টের অপব্যহার থামছে না!

বাংলাদেশে মোবাইল কোর্ট এখন চলছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ দিয়ে৷ হাইকোর্ট আগেই মোবাইল কোর্ট বাতিলের রায় দিয়েছে৷ এই অবস্থায়ও মোবাইল কোর্টের অপব্যহার থামছে না৷ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে৷

সবশেষ গত শুক্রবার মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডিসি অফিসে মোবাইল কোর্ট এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে নতুন করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে৷ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তদন্ত করে ওই ঘটনায় আইনের অপব্যবহার ও লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে৷

সোমবার কুড়িগ্রামের ডেপুটি কমিশনার সুলতানা পারভিন ও তিনজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ এই ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনেরও শুনানি চলছে৷ হাইকোর্ট সাংবাদিক আরিফুলকে আটক ও সাজা দেওয়ায় অনিময়মের ঘটনা দেখতে পুরো নথি তলব করেছে৷ আরিফুলকে নির্যাতনও করা হয়েছে৷ আগামী সোমবার হাইকোর্ট সেই নির্যাতনের ঘটনা তার মুখে শুনবেন৷

রিটকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট ইসরাত জাহান জানান, ‘‘মোবাইল কোর্ট আইনেই অপব্যহারের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে৷ কারণ এই আইনে যে ম্যাজিষ্ট্রেট আটক করেন, তিনিই সাক্ষ্য প্রমাণ দেন এবং তিনিই শাস্তি দেন ৷ ফলে তিনি যা খুশি তা করতে পারেন৷ প্রচলিত আইনে পুলিশ আটক করে৷ শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা আদালতের৷ সব ক্ষমতা একজনের হাতে থাকলে তার অপব্যবহারতো হবেই৷’’

সাংবাদিক আরিফের ক্ষেত্রে এমনকি মোবাইল কোর্টের যে আইন আছে তাও মানা হয়নি বলে জানান তিনি৷ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে মোবাইল কোর্টের নামে আনাচার করা হয়েছে৷ তিনি বলেন,‘‘অভিযান হয়েছে টাস্কফোর্সের নামে৷ শাস্তি দিয়েছে মোবাইল কোর্ট মাদকদ্রব্য আইনে৷ অভিযান চালানো হয়েছে মধ্যরাতে, ঘরের দরজা ভেঙে৷ আবার ঘটনাস্থলে শাস্তি না দিয়ে ডিসি অফিসে দেয়া হয়েছে৷ এখানে সংবিধান, মাদক আইন, ফৌজদারি আইন এবং মোবাইল কোর্ট আইন সব কিছুরই লঙ্ঘন হয়েছে৷’’

মোবাইল কোর্টের নামে এই স্বেচ্ছাচারি ঘটনার আরো অনেক উদাহরণ আছে৷ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্মীপুরের তখনকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শেখ মুর্শিদুল ইসলাম সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা কাটাকাটির জের ধরে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন৷

২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আশরাফুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে কথা বলতে নিষেধ করায় শিক্ষক মোনতাজ উদ্দিনকে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নেন তিনি৷ পরে তাকে পা ধরতে মাফ চাইতে বাধ্য করা হয় শাস্তির ভয় দেখিয়ে৷

২০১১ সালে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হাসেমের দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় দৈনিক সিলেট বাণী পত্রিকার সাংবাদিক আকবর হোসেনকে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তিন মাসের জেল দেয়া হয়৷

আর গত বছরের অক্টোবরে সংবাদ মাধ্যমে ১২১ শিশুকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ড দেয়ার ঘটনা প্রকাশ পায়৷ আদালত গত ১১ মার্চ ওই দণ্ড বেআইনি ঘোষণা করে৷ হাইকোর্ট বলেন, ‘‘এটা শুধু বেআইনি নয়, চূড়ান্ত অমানবিকতা৷’’

মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন বিচার বিভাগের বাইরের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটরা৷ ২০১৭ সালের ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ২০০৯ সালের আইনের ১১টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট৷ একইসঙ্গে, এই আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত৷

রায়ে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত৷ এটি ক্ষমতার পৃথককরণ নীতিরও পরিপন্থী৷ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্ম-কমিশনের সব সদস্যরা প্রশাসনিক নির্বাহী৷ একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না৷

কিন্তু সরকার এর বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করলে তা গ্রহন করে হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা আপিল বিভাগ স্থগিত করে৷ আর সেই স্থগিতাদেশের ভিত্তিতে এখনো মোবাইল কোর্ট চলছে৷

মোবাইল কোর্ট বাতিলে রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম বলেন,‘‘আমি তিন জন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষ হয়ে ওই রিট করেছিলাম৷ মোবাইল কোর্টের অপব্যবহারের প্রশ্নের চেয়ে বড় কথা হলো এটা সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থী৷ কারণ বিচারকাজে নিয়োজিত নয় এমন কেউ বিচার করতে পারেন না৷ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটরা বিচারক নন৷

সংবিধানে বিচার বিভাগ আলাদা ও স্বাধীন থাকার কথা বলা আছে৷ আর মোবাইল কোর্টের ম্যাজিষ্ট্রেটরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না৷ কারণ তারা প্রশাসনের অধীন৷ পুলিশের কাজ বিচার করা নয়৷ যারা ম্যাজিস্ট্রেট তারা আইন পড়ে আসেন না৷ তাদের প্রশিক্ষণও নেই৷ যার কাজ তাতে করতে হয়৷ তাই আমরা এখন মোবাইল কোর্টের অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছি৷ এটা নিজের জন্য বা ভাই ব্রাদারের জন্য ব্যবহার করা হয়৷’’

তিনি বলেন,‘‘সরকার মোবাইল কোর্ট বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে৷ কিন্তু এর শুনানি শুরু হচ্ছে না৷ ইচ্ছা করে মোবাইল কোর্ট টিকিয়ে রাখতে সরকার আপিল শুনানি ঝুলিয়ে রেখেছে৷”

এসএইচ-০৮/১৭/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)