বিদেশফেরতরাই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে!

সারাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বিদেশফেরতরাই। সিভিল এভিয়েশনের হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় বিদেশ থেকে দেশে এসেছে ৭৯০৬ জন। এ পর্যন্ত বিভিন্ন পথে দেশে এসেছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপি। এসব বিদেশফেরতই এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে।

এদেরকে বিমানবন্দরে প্রাথমিক পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষে কমপক্ষে ১৪দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগই তা মানছেন না। এতে করে সারাদেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশফেরতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বৃহস্পতিবার মাদারীপুরের শিবচরকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে।

হাইকোর্ট এক আদেশে ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ না মানা বিদেশফেরতদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করতে বলেছেন। সরকারের নির্দেশে ইতোমধ্যে সারাদেশে হোম কোয়ারেন্টাইন না মানা বিদেশফেরতদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।

জানা গেছে, হোম কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আরও কঠোর হবে সরকার। অ্যাকশনে যাবে প্রশাসন। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলা ও প্রস্তুতি নিয়ে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তিনটি আলাদা কমিটি গঠন এবং লকডাউন বা শাটডাউন নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে।

সংক্রমণ পরিস্থিতি স্টেজ-৩ ছাড়া লকডাউনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরের সচিব ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ রোধে ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ নিশ্চিতে বিদেশ ফেরত সাড়ে ছয় লাখ ব্যক্তিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পথে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাসহ তাদের নামের তালিকা ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে পাঠানো হয়েছে।

এতে সংশ্লিষ্টদের নিজ বাড়িতে সার্বক্ষণিক অবস্থান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করতে বলা হয় ডিসিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে। এছাড়া বিভাগীয় ও জেলা শহরে হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে রাখা মানুষের জন্য নগদ টাকা, জিআর চাল ও শুকনা খাবার চেয়েছেন বিভিন্ন জেলার ডিসি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ডিসিদের চিঠিতে করোনা আইসোলেশন সেন্টারের আসবাবপত্র, চিকিৎসকদের পোশাক, মেডিসিন ও রোগীর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের অভাবের কথা তুলে ধরা হয়।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, হোম কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করতে কঠোর হবে সরকার। এতে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জরিমানাও করা হবে। এছাড়া জনগণের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালাবে সরকার। সংবাদ মাধ্যম, সোস্যাল মিডিয়া ও মোবাইলে এসএমএস দেয়া ছাড়াও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সারা দেশের বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসায় জনসচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দেয়া হবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জাতীয় কমিটির নিচে তিনটি কমিটি গঠন করবে সরকার। একটি কমিটি যাবতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিষয়গুলোকে নিশ্চিত করবে। এ কমিটি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট জনবল দিয়ে গঠন করা হবে। বিভিন্ন জেলায় আইসোলেশন ইউনিট গঠন, আইসোলেশন ইউনিটগুলোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং জনগণের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে এ কমিটি। দ্বিতীয় কমিটি হবে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা নিয়ে। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশসহ স্থানীয় সরকারগুলো সম্পৃক্ত থাকবে। বিদেশ থেকে আগতের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের পরিবারের কারো আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেলে পরিবারের সেই সদস্যেরও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করবে এ কমিটি।

হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি উঠে আসে আলোচনায়। প্রতিবেশী ও পাড়া-মহল্লার জনসাধারণের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হবে। সেই সঙ্গে নির্দেশনা অমান্যে জরিমানারও বিধানের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। আর তৃতীয় কমিটি বিদেশ থেকে আগতদের বিষয়টি দেখার পাশাপাশি ক‚টনৈতিক সেবা নিশ্চিত করবে। এ কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

লকডাউন বা শাটডাউন নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। করোনাভাইরাস সংকটকে তিনটি স্টেজে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম স্টেজ হলো বিদেশ থেকে আগতদের করোনাভাইরাস আক্রান্ত। দ্বিতীয় স্টেজ হিসেবে বিদেশ থেকে আগতদের মাধ্যমে পরিবারের মানুষদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়া। আর তৃতীয় স্টেজ হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে মহামারী আকারে এ রোগ ছড়িয়ে পড়া। বাংলাদেশ স্টেজ-৩-এর বেলায় লকডাউন বা শাটডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বৈঠকে কমিটি জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়ে জোর দিয়েছে। করোনাভাইরাসের মতো সংকট মোকাবেলায় আমাদের আত্মোপলব্ধি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব মানুষকে সচেতন হতে হবে। সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয় এমন সামাজিকতা কমিয়ে দিতে হবে। এটি শুধু নিজের সুরক্ষার জন্য নয়, বরং পুরো কমিউনিটি এবং দেশের জন্য জরুরি।

এদিকে গত বুধবার রাতে এক অফিস আদেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং গঠিত কমিটিকে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে সার্বক্ষণিক নজরদারিসহ জনসচেতনতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সব ডিসিকে এ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিদেশ ফেরত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তাকেও কমপক্ষে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি সব দফতরে দর্শনার্থীর সাক্ষাৎ সীমিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেওেছন, যারা হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমন ঘোষণার পর বিদেশফেরত ব্যক্তিদের নজরধারিতে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে প্রস্তুত রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল এমন তথ্যই জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম।

বুধবার দুপুরে র‌্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। তবে এমন নির্দেশনা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। করোনা মোকাবেলায় বিদেশফেরকদের নির্দিষ্ট এলাকায় রাখার ক্ষেত্রে নির্দেশনা পেলে অবশ্যই র‌্যাব কাজ করবে।

তিনি বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম অনেকে মানছেন না। বাইরে থেকে দেশে ফেরা সকলকেই বাধ্যতামূলকভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আমরা নজরদারি করছি। আদেশ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, র‌্যাবের কাজই হচ্ছে মানুষের সেবা করা। এ জন্য নিজেদের সুরক্ষা আগে জরুরি। সেজন্য প্রত্যেককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিশেষ ছুটি যেন কেউ ভোগ না করেন। কেউ ছুটিতে থাকলে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা চেক করা হচ্ছে। মাস্ক ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সব নিয়ম মানতে বলা হয়েছে।

এসএইচ-০৭/২০/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : আমাদের সময়)