অর্থনৈতিক মন্দার মুখে বাংলাদেশ!

সারাবিশ্বে দ্রুত সংক্রমণ হচ্ছে করোনা ভাইরাসের। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের আক্রমণ মানবশরীরের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ আক্রমণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ভয়াবহ মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও করোনার প্রভাব মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে।

সরকারি ভাবে নীতিসহায়তার পাশাপাশি নগদ বরাদ্দ দিয়ে অর্থনীতিতে করোনার সংকট কাটানোর চেষ্টা চলছে; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক কম। ‘লকডাউন’-এর মতো অবস্থায় নিয়ে করোনার প্রভাব মোকাবিলার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। তাই বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৩টি দেশ ও অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৯। মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৪৯৬ জন। বাংলাদেশে গত ১৮ মার্চ প্রথমবারের মতো একজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে সরকার। গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ জন। এ করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে রীতিমত ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে।

শিল্পোৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কর্মকা- অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির শক্তিধর দেশগুলোও ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। অর্থনৈতিক এ মহাদুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজ নিজ দেশের আর্থিক খাত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; সর্বোপরি নিজ জনগণকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে প্রণোদনামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো প্যাকেজ এখন পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়নি।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ৮২ হাজার কোটি ডলারের জরুরি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি)। এর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত গ্রিস, ইতালিসহ পুরো ইউরো জোনে সরকারি ও সংস্থার যে দেনা রয়েছে, তা পরিশোধ করা হবে। এক লাখ কোটি ডলারের প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন, যার মধ্যে ২৫ হাজার কোটি ডলার নাগরিকদের সরাসরি অর্থ প্রদানের জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা।

এ ছাড়া নীতিনির্ধারণী সুদের হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। ব্যাংক অব জাপানও সহজ করেছে মুদ্রানীতি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬৫০ কোটি ডলার এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৫০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে। কানাডা নাগরিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৮ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যুক্তরাজ্য ৪০ হাজার কোটি ডলার, ফ্রান্স ৫ হাজার কোটি ডলার, কাতার ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবিলায় আর্থিক প্রণোদনা এবং আয় ও চাকরির ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।

আক্রান্ত সব দেশই অর্থনীতিকে রক্ষা করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে শুধু ঋণ পরিশোধের সময় বৃদ্ধি ও আমদানি-রপ্তানিতে কিছু ডকুমেন্ট সরবারহের সময় বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার কারণে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ২০টি দেশের একটি হবে বাংলাদেশ; কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের ঘোষণা এখনো আসেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রপ্তানি, পর্যটন ও যোগাযোগ খাত। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি মূল উদ্দীপক পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। এসবের বাজার ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির জন্য ভারত ও চীনের ওপর নির্ভরশীল সবচেয়ে বেশি।

এই দেশগুলো করোনার কারণে লকডাউন অবস্থায় রয়েছে। এসব দেশের সঙ্গে পণ্য শিপমেন্টসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। কাঁচামালের অভাবে পোশাকশিল্প বন্ধের উপক্রম। রপ্তানির বাজার-দেশগুলোও লকডাউনে। পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কর্মরত। কারখানা বন্ধ হলে এসব মানুষ বেকার হয়ে যাবে; অর্থনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এক দিকে বৈদেশিক আয় কমে যাবে অন্য দিকে কর্মহারিয়ে মানুষ বেকারে পরিণত হবে।

পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ইউরোপ ও চীনে আক্রমণের ফলে সংকট বাড়ছে। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ পরিস্থিতি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তা হলে আমাদের অর্থনীতিতে কী হবে, তা বলতে পারব না। আমাদের রপ্তানি খাতে একটা ঝড় বয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেভাবে আদেশ বাতিল হচ্ছে এতে কারখানা বন্ধ হলে অনেকেই চাকরি হারাবেন। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের নিজস্ব তাগিদে সম্ভব হবে না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো সংকট কাটাতে বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বিপর্যয় আনবে এ সংক্রমণ। লকডাউন করে সব মানুষের খাদ্য ও চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।

তবে চরম ক্ষতি এড়াতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। সরকার বিশেষ তহবিল গঠন করে বেকারত্বকালে ভাতা দিতে পারে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধসূচি সহজ করতে পারে। বাজেটনীতি ও মুদ্রানীতিতে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন বাজারে অর্থ সরবারহ বাড়ানো যায়। এসব পদক্ষেপ নেওয়া গেলে আর্থিক ক্ষতি কিছুটা কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, বাংলাদেশের সক্ষমতাও খুব সীমিত। অনেক উন্নত দেশও যেখানে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সমস্যা হওয়ারই কথা। আমাদের সক্ষমতা যতটুকু, ততটুকুই আমাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার সংক্রমণ অর্থনৈতিক মন্দা এনেছে আরও আনবে। এটি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজেট ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাজারে টাকার সরবারহ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে রপ্তানি তথা পোশাক খাতের সংকট চোখে পড়ছে। সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে এসএমই খাতে বিপর্যয় নামবে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদের টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে বরাদ্দ দিতে হবে।

এসএইচ-০৭/২১/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : আমাদের সময়)