লকডাউন নিয়ে বিপাকে কাঁচা পণ্য উৎপাদকরা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার থেকে টানা ১০ দিন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি শুরু হয়েছে।

সরকারি নির্দেশ মোতাবেক আজ ছুটির প্রথম দিনে ঢাকার সড়কগুলোয় গণপরিবহনের চলাচল ছিল খুই কম।

বেশিরভাগ এলাকায় দু-একটি প্রাইভেট কার,হাতে গোনা কয়েকটি রিকশা ও মোটরসাইকেল ছাড়া কোন ধরণের যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। বন্ধ রয়েছে রাইড শেয়ারিং অ্যাপও।

ফার্মেসি এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কিছু দোকান ছাড়া বাকি সব বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।

ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এই কড়াকড়িকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

ঢাকার বাসিন্দা মৌ খন্দকার জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখতে পান মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরা।

“নিউমার্কেটের মতো ব্যস্ত এলাকাও আজ একেবারে ফাঁকা, একটা দুটা গাড়ি যাচ্ছে, বেশিভাগই বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির গাড়ি। পুলিশ সবাইকে দাঁড় করিয়ে আইডি কার্ড দেখছে। জানতে চাইছে যে তারা কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন,” তিনি বলেন।

তবে অপ্রয়োজনে বের হওয়ার কারণে কয়েকজনকে শাস্তি পেতেও দেখেছেন তিনি।

“আমি দেখলাম দুই একজন এমনিই হেঁটে যাচ্ছে। কোন কারণ ছাড়া। তারপর পুলিশ তাদের আটকাল, জিজ্ঞাসাবাদ করলো। বুঝলাম যে তারা বের হওয়ার প্রয়োজনীয় কোন কারণ বলতে পারেননি। এরপর তাদেরকে কান ধরে উঠবস করানো হয়।”

তবে এই লকডাউন পরিস্থিতিতে বড় ধরণের সংকটের মুখে পড়েছেন পচনশীল খাদ্য পণ্যের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা।

কারণ সরকারি নির্দেশনায় পচনশীল খাদ্যপণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হলেও তাদেরকে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।

ফরিদপুরের কানাইপুর উপজেলার শোলাকুন্ডু গ্রামের সবজি চাষি কলম চকদার অর্ধেক দামেও তার সবজি বিক্রি করতে পারছেন না।

তিনি বলেন,”বাজারে পণ্য দেয়ার পর দেখি লোকজন নাই। দাম একেবারে পড়ে গেছে। ছয়শ টাকার মাল বেচলাম তিনশ টাকায়। গরমকালে সবজি রাখলেও তো পচে যাবে।”

এছাড়া গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলা শহর থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সবজি কেনার জন্য আসতে পারছেন না।

“পাইকারিরা জানে যে তারা বিক্রি করতে পারবে না। রাস্তায় গাড়ি নাই আসতেও পারছে না। তো অর্ধেক দামেও কিছু কিনছে না। এমনি এমনি সবজি দিয়ে দিচ্ছি মানুষকে। কি করবো?” বলেন, চকদার।

বাংলাদেশের তরল দুধ উৎপাদকরাও বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

কেননা সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে সব ধরণের রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখতে হবে।

কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এই রেস্তোরাঁর আওতায় মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

যার একটা বড় প্রভাব পড়েছে তরল দুধের বাজারে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট দুধের প্রায় ৮৪% বিভিন্ন মিষ্টি দোকানে ও বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হয়।

এখন এই মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।

এই হিসাব দিয়েছেন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেইন।

তরল দুধের বাজারের ধস ঠেকাতে মিষ্টির দোকানগুলো খুলে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

হোসেইন বলেন, “সরকারি সার্কুলারে বলা হয়েছে যে দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় পণ্য যাতায়াতে বা পণ্য বিক্রি করতে কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু সমস্যা হল মিষ্টির দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা দুধ বিক্রি করতে পারছেন না। এখন গরু তো প্রতিদিন দুধ দেবে। এটা তো বন্ধ করা যাবে না। প্রতিদিনের দুধ তো প্রতিদিনই বিক্রি করতে হবে। এতো দুধ তো সংরক্ষণের উপায় নেই।”

এ অবস্থায় প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে দুধ ফেলে দিতে হচ্ছে বলে তিনি আক্ষেপ করেন।

একই চিত্র পোল্ট্রি ব্যবসাতেও। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের বাধার মুখে পড়ার কারণে, তারা ভোক্তার কাছে সময় মতো ডিম সরবরাহ করতে পারছেন না। এতে প্রচুর ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এসব পণ্য পরিবহনে যে নিষেধ নেই- মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সেটা মানতে চাইছে না বলে জানান ফরিদপুরের এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং খামারি এমএমডি জামান।

তিনি বলেন, “ধরেন আমার ফার্মের ডিমগুলো মাদারীপুরে পাঠাবো। প্রথমত, এই অবস্থায় কেউ যেতে চাবে না। আবার গেলেও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ আটকায়। তখন উপরের লেভেল থেকে পারমিশন নিতে নিতে কাঁচা পণ্য পচে যায়।”

যে চালকরা এই পণ্য পরিবহন করেন, তারা পুলিশকে সরকারি প্রজ্ঞাপনের লিখিত কপি দিলেও পুলিশ সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।

এখন তিনি বুঝতে পারছেন না সমাধানের জন্য কার কাছে যাবেন।

“মুরগি ডেইলি ডিম দেবেই। এটা ঠেকাতে যাবেনা। ভোক্তাদের পণ্য দরকার। কিন্তু আমার পণ্য তো ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারছিনা। লস বেড়েই যাচ্ছে। আসলে আমরা এইজন্য যে কার কাছে যাব। এটাই বুঝে উঠতে পারছি না।” বলেন, জামান।

এ ব্যাপারে সরকারের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে বা নিয়ম নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করেছে এমন কোন অভিযোগ পেলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এসএইচ-০৪/২৭/২০ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)