প্রণোদনা অস্বচ্ছ হলে পাচারের আশঙ্কা

করোনার ক্ষতি সামলাতে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে৷ আর গরীব মানুষের জন্য জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে দেয়া হবে খাদ্য সহায়তা৷

প্রশ্ন উঠেছে এই সময়ে কাদের সহায়তা আসলে দরকার৷ আর যাদের দরকার তারা পাবেন কিনা৷ অতীতে বাংলাদেশে প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ আছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা৷ কেউ আশঙ্কা করছেন প্রণোদনার অর্থ না আবার দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়৷

দেশের এই পরিস্থিতিতে কাদের সহায়তা প্রয়োজন তার একটা অগ্রাধিকার তালিকা দিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর৷ তার মতে যাদের প্রণোদনা দরকার-

১. শুধু রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক নয়, সব ধরনের শ্রমিক৷

২. অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা৷ যেমন রিকশাচালক, দিনমজুর, কৃষক, ছোট ছোট ভাসমান দোকানদার৷

৩. ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা এসএমই খাতের শ্রমিক এবং উদ্যোক্তা৷

রপ্তানি খাতে প্রণোদনা ঘোষণার পর এখন দেশের বিভিন্ন খাত থেকে প্রণোদনার দাবি উঠেছে৷ আর এই দাবি মূলত তুলছে মালিক পক্ষ৷

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ মনে করেন, ‘‘অতীতে আমাদের প্রণোদনা ব্যবহারের ইতিহাস ভালো নয়৷ যাদের প্রণোদনা প্রয়োজন তারা সব সময় এটা থেকে লাভবান হয়নি৷ তাই এবার প্রণোদনার উপকারভোগী কারা হবেন সেটা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন৷ তা না হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যেতে পারে৷’’

রপ্তানি খাতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে তা স্পষ্টতই শ্রমিকদের বেতনের জন্য বলা হয়েছে৷ এখন প্রশ্ন উঠেছে এটা কি সবাই পাবে? তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন৷ আহসান এইচ মনসুর বলেন,‘‘কোন কারখানা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ সেই বিবেচনা করে প্রণোদনা দিতে হবে৷ আর যারা বিত্তশালী তাদের মরালিটি নিয়ে ভাবতে হবে৷ যার সামর্থ্য আছে তাকে দেয়া ঠিক হবে না৷’’

এবারকার পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে দেখেন বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ৷ তার বিবেচনায় এখন যারা সক্ষম ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা বা রপ্তানিকারদের উচিত নিজেরা অর্থ সহায়তা না নিয়ে যাদের দরকার তাদের সহায়তা করা৷ তিনি বলেন, ‘‘পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন সরকার দিয়ে দেবে এটা হতে পারে না৷ এটা কষ্ট করে হলেও মালিকদের দিতে হবে৷ এই পাঁচ হাজার কোটি টাকার সাথে আরো কিছু অর্থ মিলিয়ে একটা আপতকালীন ফান্ড করতে হবে৷ ওই ফান্ড থেকে প্রথমত ছোট উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে৷ এটা কোনো সেক্টর ভিত্তিক না, সব খাতের জন্য হওয়া দরকার৷’’

ড. নাজনীন মনে করেন, সরকারতো গরীব মানুষকে ত্রাণ দেবে৷ তাদের খাদ্য সহায়তা দেবে৷ কিন্তু শিল্প উদ্যোক্তাদের এই রিলিফের নামে যে যত পারে অর্থ নেয়ার মানসিকতা বাদ দিতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন যারা ছাঁটাই করছেন, বেতন বন্ধ করছেন তারা আসলে খারাপ কাজ করছেন৷ অন্তত তিন মাস তাদের দেখা উচিত৷ এটা একটা যুদ্ধ৷ এই যুদ্ধে বিত্তশালীদের মানবিক হতে হবে৷ সংকটের সুযোগ যারা নিতে চাইবেন তাদের আমি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের কাতারে ফেলতে চাই৷’’

শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে বিত্তশালীদের উদাহরণ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর৷ তিনি বলেন, ‘‘২০০৮ সালে মন্দার সময় আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে নয়ছয় হয়েছে৷ যাদের জন্য প্রণোদনা তারা সেটা সামান্যই পেয়েছেন৷ সাধারণ মানুষের উপকারে আসেনি৷ প্রণোদনা সুনির্দিষ্ট হতে হবে৷ যার জন্য প্রণোদনা তিনি যাতে পান তার জন্য মনিটরিং এবং শৃঙ্খলা আনতে হবে৷ প্রণোদনা হতে হবে শর্তযুক্ত৷ নয়তো এটা কিছু মানুষের পকেটে যাবে৷ পাচার হয়ে যেতে পারে প্রণোদনার অর্থ৷’’

আর প্রণোদনা নিয়ে অতীতে ‘ধান্ধাবাজির’ অভিজ্ঞতার আলোকে ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ বলেন, ‘‘কোনোভাবেই ব্যক্তির ওপর ছেড়ে দেয়া যাবে না৷ কোনো প্রতিষ্ঠানের অসৎ মালিককে দেয়া হলে তিনি ধান্ধাবাজি করতে পারেন৷ তাই যেকোনো উপায়ে এটার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে৷ যার জন্য প্রণোদনা তার পাওয়া নিশ্চিত না করা গেলে এই প্রণোদনা খুব বেশি কাজে আসবে না৷’’

এসএইচ-০৭/০১/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)