বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের জন্য ইসলামপন্থী কয়েকটি দল যে দাবি তুলেছে, তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে দলটির ঘনিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার বলেছেন, সরকার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল বা সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতার রাজনীতির সুযোগ নিয়ে তারা এখন শেখ মুজিবের ভাস্কর্যের ওপরই আঘাত করছে। যেটা আওয়ামী লীগের জন্যই বিব্রতকর বলে তারা মনে করেন।
ঢাকার দক্ষিণে ধোলাইপাড় মোড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী কয়েকটি দল কয়েকদিন আগে ঐ এলাকায় সমাবেশ করেছে।
এই দলগুলো শেখ মুজিবের ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে এর নির্মাণ বন্ধ করা না হলে আরও কর্মসূচি দেয়ার হুমকি দিয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে যদিও আওয়ামী লীগের সমমনা কিছু সংগঠন বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ করেছে এবং আওয়ামী লীগের দু’একজন নেতা নিজেদের মতো করে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন।
তিনি এটুকুই বলেছেন যে, বিষয়টা সরকার পর্যবেক্ষণ করছে।
দলটির সাথে ঘনিষ্ট বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, শেখ মুজিবের ভাস্কর্য নিয়ে আঘাত আসার পরও আওয়ামী লীগের সতর্ক অবস্থান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু প্রবল বিক্ষুব্ধ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েই ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি এনেছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিষয়কে এনেছিলেন। এখন আজকে যদি আমরা যারা অগ্রসরমানতার কথা বলি, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, তারা যদি পিছিয়ে যান, সেটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে বলে আমি মনে করি।”
বিশ্লেষকদের অনেকে আবার পরিস্থিতিটাকে আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তির বা বিব্রতকর বলে মনে করেন।
তারা বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের সাথে আওয়ামী লীগের সখ্যতা এবং ধর্মভিত্তিক দল বা বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সমঝোতা করে চলা – এই সুযোগ নিয়েই তারাই আওয়ামী লীগের স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরিন বলেন, পরিস্থিতির দায় আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তায়।
“আমার কাছে মনে হয়, আওয়ামী লীগ ইসলামী দলগুলোকে আশকারা দিয়ে এপর্যায়ে এনেছে যে এখন আওয়ামী লীগের খোদ নিজের ঘরেই সাপ ঢুকেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ যে কারণে আশকারা দিয়েছে, সেটা হচ্ছে ভোট এবং ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখার জন্য। সেই জায়গায় নিতে নিতে আওয়ামী লীগ এখন এর ফল ভোগ করছে সবচেয়ে বেশি। কারণ আওয়ামী লীগের এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে তারা না পারছে হজম করতে, তারা না পারছে বমি করে ফেলে দিতে।”
বিশ্লেষকরা এটাও বলেছেন, বাংলাদেশে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা নতুন বিষয় নয়।
তিন বছর আগেও ২০১৭ সালে ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রীক দেবীর আদলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের বিরোধীতার মুখে সেই ভাস্কর্য সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
এখন ইসলামপন্থী যে দলগুলো ঢাকার ধোলাইপড়ে শেখ মুজিবে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে, তার মধ্যে অন্যতম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেছেন, আওয়ামী লীগ ইসলামী শরিয়তের বিরুদ্ধে কিছু করবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটাই তারা এখন মনে করিয়ে দিয়েছেন।
“আমাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে যে ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে সে কিন্তু একটা কথা বলেছিলো যে শরিয়া বিরোধী কোন আইন সে পাস করবে না এবং শরিয়া বিরোধী কোন পদক্ষেপ সে গ্রহণ করবে না।”
তিনি ভাস্কর্য এবং মূর্তির মধ্যে কোন পার্থক্য মানতে রাজি নন।
ভাস্কর্য এবং মূর্তি একই বিষয়। যেহেতু ইসলামী শরিয়ত এটাকে সমর্থন করে না, সে হিসাবে আমরা এটার প্রতিবাদ করেছি। আর সাথে আমরা বলেছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যে ভূমিকা বা অবদান, এ ব্যাপারে তার জন্য দোয়া এবং তার রুহের মাগফেরাতের জন্যে আল্লাহর ৯৯ নাম খচিত একটা মিনার বা ঐ ধরনের একটা স্মৃতি যদি তৈরি করা যায়, তাহলে এর মাধ্যমে তার রুহের ওপর সোয়াব পৌঁছুতে থাকবে।”
ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের এমন বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বগুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় দলটির কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
তারাও মনে করেন, এটি তাদের দলের নেতৃত্বকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তারা আশার করেন, সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান নেয়া প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারনী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সিনিয়র মন্ত্রী ড: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, তাদের দলের উচ্চপর্যায়েও বিষয়টি আলোচনা হয়েছে।
তিনি দাবি করেছেন, বিষয়টি তাদেরকে অস্বস্তিতে ফেলেনি।
“সখল ধর্মকেই আমরা সমান সম্মান করি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বিচার করার কোন সুযোগ নাই। এটা শিল্প। আমরা মনে করি না যে সরকার কোন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কেউ যদি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এটা প্রচার করে বা ধর্মীয় দিক থেকে অপব্যাখ্যা দেয় – তা ঠিক হবে না।”
আওয়ামী লীগের আরও একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, তারা মনে করেন, বিষয়টাতে তাদের স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরা হবে।
এসএইচ-১১/১৮/২০ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)