পুলিশের প্রধান বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘‘পুলিশে দুর্নীতিবাজদের কোনো জায়গা নেই৷’’ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে পুলিশে অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা? আর আইজিপির এটা কি শুধু কথার কথা?
মঙ্গলবার তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক মতবিনিময় সভায় আরো বলেন, ‘‘কোনো পুলিশ সদস্য অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না৷ দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা বদ্ধপরিকর৷ পুলিশ হবে ঘুস ও দুর্নীতিমুক্ত৷’’
ওই মত বিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম৷ আর এই পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলামেরই আইজিপিকে দেয়া একটি চিঠি বেশ আলোড়ন তুলেছিল কয়েকমাস আগে৷ তিনি ৩০ এপ্রিল তার অধীনস্ত যুগ্ম কমিশনার (লজিস্টিক) মো. ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইজিপিকে চিঠি দিয়েছিলেন৷
অভিযোগ, ওই যুগ্ম কমিশনার কেনাকাটায় খোদ পুলিশ কমিশনারকেই ‘পার্সেন্টেজ’ দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন৷ তিনি যুগ্ম কমিশনারের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগও করেন৷ এই চিঠির ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় এক মাস পরে৷ কিন্তু ওই একমাসে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ যখন খবর প্রকাশ হয় তারও ১০ দিন পর ৯ জুন তাকে শুধু বদলি করা হয়৷ তাও করেন পুলিশ কমিশনার নিজে৷ আর কোনো ব্যবস্থা বা তদন্তের কোনো খবর এখনো জানা যায়নি৷
পুলিশের বহুল আলোচিত ডিআইজি মিজানুর রহমান এখন কারাগারে৷ ঘুস লেনদেনের ঘটনায় তাকে হাইকোর্টের নির্দেশে আদালত থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ২ জুলাই৷ কিন্তু এর আগে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ প্রায় বছর জুড়ে তার নানা অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির খবর সংবাদমাধ্যমে ছাপা হওয়ার পরও না৷ গত বছরের ২৪ জুন দুদক তার বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা করলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়৷
৩১ জুলাই কক্সবাজারে ক্রসফায়ারের নামে মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার পর টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি প্রদীপ কুমার দাসকেও রক্ষায় পুলিশের একটি মহল তৎপর ছিলো৷ এমনকি তাকে ছুটি দিয়ে থানা ছেড়ে যাওয়ারও সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল৷ পরে অবশ্য প্রতিবাদ ও চাপের মুখে তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে৷
পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে সরাসরি, ইমেইল বা টেলিফোনে অভিযোগ করার সুযোগ আছে৷ কিন্তু পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতির অভ্যন্তরীণ তদন্তের আলাদা কোনো বিভাগ নেই৷ খোঁজ নিয়ে জানাগেছে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয় হয়৷ তবে এইসব ব্যবস্থার মধ্যে বদলিই বেশি৷ আর যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাদের ৯৫ ভাগেরও বেশি কনেস্টবল থেকে ইন্সপেক্টর পদের পুলিশ সদস্য৷ এএসপি ও তার উপরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণ খুবই কম৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘পুলিশের আইজি যা বলছেন তা বাস্তবে কার্যকর করতে হলে উপর থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আর বদলি, ক্লোজ আসলে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়৷ এসব দিয়ে দুর্নীতি দূর করা যায় না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘যত গবেষণা বা জরিপ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে পুলিশ সব সময় দুর্নীতিতে শীর্ষ পর্যায়ে আছে৷ সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী যারা পুলিশের সেবা নিতে যান তাদের শতকরা ৭৬ জনকে ঘুস দিতে হয়৷ এছাড়া মানুষকে হয়রানি করে, পকেটে মাদক- অস্ত্র দিয়ে পুলিশ ঘুস আদায় করে বলে অভিযোগ আছে৷ কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়৷ আইজিপি সাহেব হয়তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কারণে বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের পুলিশে কোনো জায়গা নেই৷ কিন্তু বাস্তবে এটা এত সহজ নয়৷ ঠগ বাছতে আবার গা উজাড় হওয়ার মতো না হয়৷ তবে আন্তরিক হলে এটা কঠিনও নয়৷ এখন দেখার বিষয় এটা নিয়ে তিনি কতটা আন্তরিক৷’’
‘‘পুলিশের আইজি যদি পুলিশ বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেন তাহলে এটা হবে একটি যুগান্তকারী ব্যবস্থা,’’ এই মন্তব্য দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের৷ তার মতে, যদি সব দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যকে পুলিশ বিভাগ থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে পুলিশে আর দুর্নীতি থাকবে না৷
তিনি বলেন, ‘‘শুধু পুলিশ কেন সব বিভাগেই অভিযোগের তদন্ত এবং ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভাগীয় আইন আছে৷ সেই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেয়া যায়৷’’ তবে পুলিশ সদর দপ্তর চাইলে দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ দুদকেও পাঠাতে পারে৷ দুদক তাদের মত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে বলে জানান তিনি৷
ডিএমপির নয়জন পুলিশ সদস্য মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে চাকরি হারিয়েছেন৷ ডোপ টেস্টের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে তদন্ত করা হয়৷ আরো ৫৯ জন সদস্য একই প্রক্রিয়ায় চাকরি হারানোর পথে আছেন৷ এসব কর্মকর্তা কনেস্টবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার৷
এসএইচ-০৫/১৯/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)