তিরিশ বছর আগে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এক তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু তারও তিন বছর আগে আরেকটি গণআন্দোলন তিনি নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। সেই আন্দোলনের সময় গণতন্ত্রের দাবিতে বুকে-পিঠে শ্লোগান লিখে রাস্তায় নামা এক তরুণ নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
মৃত্যুর আগে তোলা তার একটি ছবি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠে এবং তিন বছর পরের গণআন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেনের বুলেটবিদ্ধ দেহ যে কারাকক্ষে ফেলে রাখা হয়, তার পাশের কক্ষে বন্দী ছিলেন বিবিসি বাংলার মোয়াজ্জেম হোসেন। তেত্রিশ বছর পর নূর হোসেনের সেই অভিনব প্রতিবাদের নেপথ্যে কাহিনী জানার চেষ্টা করেছেন তিনি।
ঝাঁকড়া চুলের শ্যামলা রঙের ছেলেটিকে আমরা যখন দেখি, তখন তার দেহ রক্তাক্ত। কিন্তু তার শরীরে সাদা রঙে লেখা শ্লোগান তখনো জ্বলজ্বল করছে। আমরা তখনো জানি না, ছেলেটি কে, কী তার নাম।
শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ছোট্ট এক সেলে পড়েছিল কয়েকটি রক্তাক্ত দেহ।
আমরা ছিলাম ঠিক পাশের আরেকটি সেলে। সেই কয়েদখানা তখন ক্রমশ রাজনৈতিক বন্দীতে ভরে উঠছে । আমার বয়স তখন ১৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
সেদিন সকালে ঢাকা শহরে ছিল চরম উত্তেজনা। সব বিরোধী দল মিলে ঢাকায় সচিবালয় অবরোধের ডাক দিয়েছে।
সারাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় এসে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের মূল কেন্দ্র অচল করে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগে বাধ্য করবে, এটাই ছিল পরিকল্পনা।
কিন্তু ১০ই নভেম্বরের আগে প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজেই ঢাকাকে কার্যত সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। সব জেলার সঙ্গে সড়ক-রেল-নৌ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে ছাত্রদের ছাত্রাবাস ছাড়তে বলা হয়। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে সারাদেশে ব্যাপক হারে ধরপাকড় করা হতে থাকে বিরোধী দলের কর্মীদের।
কিন্তু এত বিধিনিষেধের মধ্যেও হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী তখন পৌঁছে গেছেন ঢাকায়। সেদিন সকাল নয়টায় পুরানা পল্টন এলাকার আশে-পাশে এসে জড়ো হচ্ছিলেন যারা, তাদের মধ্যে ছিলাম আমিও। সকাল নয়টায় আমি সহ বেশ কয়েকজন সেখানে দাঙ্গা পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। আমাদের লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। এরপর একটি লরিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে।
দিন যত বাড়ছিল, ঢাকা শহরের পরিস্থিতি ততই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল। আর শাহবাগে পুলিশের কারাকক্ষে নিয়ে আসা হচ্ছিল অনেক আহত মানুষ। এদের অনেকের শরীরে ছিল গুলির আঘাত।
পাশের সেলটি থেকে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ধরে আহত মানুষের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। সহ্য করতে না পেরে আমরা একটু পরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম।
ততক্ষণে সেখানে পড়ে থাকা দেহগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই, তারা জীবিত না মৃত। ছোট্ট সেলটিতে যেভাবে তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল না, শরীরের কোন অংশটি কার। একজনের শরীরের নীচে চাপা পড়েছে আরেকজনের শরীর।
কিন্তু একই সঙ্গে একজনের উদোম বুকে সাদা রঙে লেখা এক শ্লোগানে আমাদের চোখ আটকে গিয়েছিল।
“স্বৈরাচার নীপাত যাক।।”
আমাদের এক তীব্র ধাক্কা দিয়েছিল, শিহরিত করেছিল সেই শ্লোগান।
তখনো আমরা জানতাম না, এই তরুণের নাম নূর হোসেন। আমরা জানতাম না বুকে-পিঠে শ্লোগান লিখে রাস্তায় নামা নূর হোসেনের ছবিই হয়ে উঠবে আমাদের প্রজন্মের গণতন্ত্রের দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত সংগ্রামের প্রতীক।
নূর হোসেনকে নিয়ে পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা, গান, বই। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবি, প্রকাশ করা হয়েছে ডাকটিকেট। আর ঢাকার যে স্থানটিতে তার ওপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ, সেটির নাম এখন নূর হোসেন স্কোয়ার।
নূর হোসেনের যে ছবি চিরকালের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে, সেই ছবিগুলো পরে বহুবার দেখেছি আমি। কয়েকটা প্রশ্ন বারে বারে আমার মনে জেগেছে- ঢাকার এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী ভেবে সেদিন শরীরে এই শ্লোগান লিখেছিল? কে তাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল? তার শরীরে কে লিখে দিয়েছিল এই শ্লোগান?
তার অভূতপূর্ব প্রতিবাদের নেপথ্য কাহিনী জানতে তেত্রিশ বছর পর আমি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করি ।
নূর হোসেনের বাবা মুজিবুর রহমান ছিলেন এক দরিদ্র অটোরিকশা চালক। তারা তখন থাকতেন পুরনো ঢাকার বনগ্রাম রোডে। তিনি মারা গেছেন প্রায় পনের বছর আগে।
কিন্তু আমি নূর হোসেনের বড় ভাই আলি হোসেনকে খুঁজে পাই। টেলিফোনে তিনি আমাকে বলছিলেন, ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর যা ঘটেছিল সেটা তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে।
“ঘটনার দুদিন আগে নূর হোসেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমাদের বলেছিল, একটা জায়গায় যাচ্ছি, চিন্তা কইরেন না।”
নূর হোসেনের অটো-চালক বাবা মুজিবুর রহমান ততদিনে বুঝে ফেলেছেন, তার ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে, ছেলে মিছিলে যায়।
“পরপর দুই রাত যখন ও ঘরে ফিরলো না, তখন আব্বা-আম্মা ওর খোঁজে বের হলো। দশ তারিখ সকালে রাজউকের কাছে একটা মসজিদে গিয়ে ওকে পাওয়া গেল। সেখানে গিয়ে উনারা দেখেন, নূর হোসেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নুর হোসেন আব্বা-আম্মাকে দেখে তাড়াতাড়ি গায়ে কাপড় জড়িয়েছে। আব্বা জিজ্ঞেস করছে, তোর গায়ে কী লেখা আছে? ও বললো কিছু না।”
নূর হোসেনকে ঘরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তার বাবা-মা ঘরে ফিরে আসেন। কিন্তু দুপুরের দিকেই তাদের বনগ্রাম রোডের বাড়িতে খবর আসে, নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়।
ছেলের সন্ধানে মুজিবুর রহমান ছুটে যান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে। আলি হোসেন জানান, সঙ্গে ছিলেন তিনি এবং তার নানী।
“আমরা তিনজন বেরুলাম। পার্টি অফিস, পুলিশ হাসপাতাল, কোথাও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গেলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ওরা কেউ কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু ভেতর থেকে আসা পুলিশের এক সেপাই আমাদের বললো, একটা ছেলে আছে এখানে, ওর গায়ে পিঠে কিছু লেখা। ”
“তখন আব্বা বললো, আমাকে ভেতরে যেতে দিতে হবে। এ নিয়ে হট্টগোল শুরু হলে ভেতর থেকে অফিসাররা চলে আসলো। একজন পুলিশ অফিসার তখন আব্বাকে বললো, এখানে যদি এখন আমরা আপনার ছেলেকে দিতে যাই, আরও লাশ পড়বে। আপনি কি তা চান?”
নিরাশ হয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ফিরে এলেন তারা।
নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগানটা কে লিখেছিল, সেটা কি আলি হোসেন জানেন?
“হ্যাঁ, জানি। ওর নাম ইকরাম হোসেন। সাইনবোর্ড লেখার দোকান ছিল ওর।”
আলি হোসেনের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আমি ইকরাম হোসেনকে ফোন করি।
“হ্যাঁ, আমিই সেই লোক, আমিই নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান লিখেছিলাম”, বললেন তিনি।
“আমি মূলত সাইনবোর্ড, ব্যানার এসব লেখার কাজ করতাম। মতিঝিলে বিসিআইসি ভবনের কাছে ছিল আমাদের দোকান।”
১৯৮৭ সালে ইকরামের বয়স ছিল ১৮। তার দোকানটির নাম ছিল পপুলার আর্ট, আরেকজনের সঙ্গে মিলে এটি চালাতেন তিনি। আর থাকতেন তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টারে। তাঁর বড় ভাই ছিলেন বঙ্গভবনের চাপরাশি।
৯ই নভেম্বর, ১৯৮৭। ঢাকা শহর তখন অবরুদ্ধ, সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। পরদিন ঢাকায় সচিবালয় অবরোধ। পরিস্থিতি ভালো নয়। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বিকেল পাঁচটাতেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইকরাম।
কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটাতেই তার কাছে এসে হাজির নূর হোসেন।
ছেলেটির সঙ্গে সেরকম কথা হয়নি কখনো ইকরামের, তবে মুখ চেনা।
“ও আমাকে বললো, ইকরাম ভাই, আপনি এমন এক জায়গায় আজকে লিখবেন, যেখানে জীবনেও লেখেন নাই।”
ইকরাম হোসেনের শিল্পী মনে কৌতূহল জাগলো। কি এমন লেখা, যা জীবনে লেখেননি?
অফিস পাড়ায় তখন শীতের সন্ধ্যা নামছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ইকরামকে নিয়ে নূর হোসেন ঢুকে গেলেন এক ছোট্ট গলিতে। তারপর যা করলেন, তাতে হতভম্ব হয়ে গেলেন ইকরাম হোসেন। নূর হোসেন তার গায়ের জামা খুলে ফেললেন এক ঝটকায়।
“আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি জামা খুললেন কেন। নূর হোসেন আমাকে বললেন, ইকরাম ভাই, আপনি আমার বুকের এখানে লিখবেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, আর পিঠে লিখবেন , ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। আমি তো জীবনেও কোন মানুষের গায়ে লিখিনি। আমি কাউকে কখনো মানুষের গায়ে লিখতে দেখিনি।”
“আমি একটু ভয় পেলাম। আমার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের চাপরাশি। আমি থাকি বঙ্গভবনের কোয়ার্টারে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে তো আমি এরকম একটা জিনিস লিখতে পারি না। আমি বললাম, না, এটা আমি লিখতে পারবো না। আপনি এটা লিখে বাইরে গেলে পুলিশের মার খাবেন। তারপর জেলে যাবেন। আপনি মরেও যেতে পারেন।”
কিন্তু নূর হোসেন ছিলেন নাছোড়বান্দা।
“নূর হোসেন আমাকে বলেছিল, ইকরাম ভাই আমি একা না, আরও একশো জনের গায়ে এটা লেখা থাকবে। আমরা সবাই কাল এক সঙ্গে মিছিল করবো।”
নাছোড়বান্দা নূর হোসেনের চাপে শেষ পর্যন্ত ইকরাম হোসেন কাজটি করে দিলেন।
কী লিখতে হবে, তা নূর হোসেন নিজেই চক দিয়ে প্রথমে দেয়ালে লিখেছিলেন। সেই লেখা দেখে নূর হোসেনের বুকে আর পিঠে তিনি সাদা রঙে আঁকলেন সেই বিখ্যাত শ্লোগান:
স্বৈরাচার নীপাত যাক।।
গণতন্ত্র মুক্তি পাক।।
যেভাবে ভুল বানানে নূর হোসেন চক দিয়ে দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে।
বুকে-পিঠে দুদিকেই শ্লোগান লিখে শেষে দুটি করে দাড়ি দিয়েছিলেন।
এটি কেন করেছিলেন, জানতে চাইলাম আমি।
“এটা আমি করেছিলাম একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। যেহেতু নূর হোসেন বলেছিল আরও একশো জনের গায়ে শ্লোগান লেখা থাকবে, তার মধ্যে আমার লেখা শ্লোগান যেন আলাদা করে চেনা যায়, সেজন্যে। কিন্তু নূর হোসেন আমাকে আসলে মিথ্যে কথা বলেছিল। সে একাই আসলে সেদিন এভাবে রাস্তায় নেমেছিল। আর কেউ গায়ে শ্লোগান লিখে নামেনি সেইদিন।”
পেছন থেকে তোলা যে বিখ্যাত ছবিটি নূর হোসেনের প্রতিবাদকে অমর করে রেখেছে, সেই ছবিটি তুলেছিলেন খ্যাতিমান আলোকচিত্র সাংবাদিক পাভেল রহমান। তখন তিনি কাজ করেন ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনে।
পাভেল রহমানের পরিষ্কার মনে আছে ছবি তোলার আগের সেই মূহুর্তগুলো।
নভেম্বরের সকাল। রোদ বাড়ছিল। আটটা সাড়ে আটটার দিকে পল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের এক দফা সংঘর্ষ মাত্র শেষ হয়েছে।
“হঠাৎ দেখলাম সেখানে আমার ঠিক গা ঘেঁষে একটি ছেলে চলে যাচ্ছে। ছেলেটার পুরো পিঠ-জুড়ে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’- যেন এক চলমান পোস্টার। ওকে দেখে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। আমি ক্যামেরাটা চোখে তুললাম। দুটি শট নিলাম। একটা হরাইজন্টাল। একটা ভার্টিক্যাল।’
এরপর ছেলেটা মিছিলে হারিয়ে গেল। তাকে আর খুঁজে পেলেন না পাভেল রহমান।
সন্ধ্যায় যখন তিনি পত্রিকার ডার্করুমে কাজ করছেন, তখন এক সহকর্মী জানালেন, গায়ে শ্লোগান লেখা সেই বিক্ষোভকারী মারা গেছেন।
ছবিটি প্রকাশ করা হবে কীনা তা নিয়ে সেদিন নিউ নেশনে কিছুটা বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। সরকার ক্ষিপ্ত হতে পারে এই আশংকায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলো। পরেরদিন পত্রিকার ফোল্ডের নীচে দুই কলামে ছাপা হলো পেছন থেকে তোলা নূর হোসেনের সেই বিখ্যাত ছবি।
“ছবিটা প্রকাশ হওয়ার পর বেশ সাড়া পড়ে গেল। আমি কিছু ফোন পেলাম নানা জনের কাছ থেকে। প্রেসিডেন্ট নাকি খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছেন এই ছবি দেখে। সরকার বলছিল, এরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি। ফটোগ্রাফার এই ছবিটি বানিয়ে তুলেছে।”
“একথা শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। কয়েকদিনের জন্য আমাকে গা ঢাকা দিতে হয়।”
এই ছবি পরে পোস্টার করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সারা দেশে।
“আমি প্রায় ৪৫ বছর ধরে ফটোসাংবাদিকতায় জড়িত। কিন্তু এই একটি ছবি আমাকে যত খ্যাতি, যত পরিচিতি দিয়েছে, তা বোধহয় আর কোন ছবির বেলায় হয়নি।”
“এখনো যখন আমি ছবিটা দেখি, আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছে। গায়ে জামা নেই। কোঁকড়া চুল। টগবগে এক তরুণ। এরকম দৃশ্য আর কখনো দেখিনি।”
তবে এই প্রতিবাদী তরুণ আসলে কে সেটা একটা রহস্যই থেকে যেত, যদি না আরেক সাংবাদিক দিনু আলম সামনে থেকে নূর হোসেনের অনেক ছবি তুলতেন।
দিনু আলম এখন থাকেন কানাডায়। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকায় নতুন বার্তা নামের একটি পত্রিকায় কাজ করতেন।’
সেদিন একটি ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে তিনি সারাদিন বহু ছবি তোলেন পল্টন-সচিবালয়-জিপিও এলাকায়। এর মধ্যে অনেকগুলো ছবি ছিল নূর হোসেনের।
“নূর হোসেনের যত ছবি আমি তুলেছিলাম, তার সবগুলোই সামনে থেকে। তার শরীরের পেছনেও যে গণতন্ত্র মুক্তি পাক বলে শ্লোগান লেখা ছিল সেটা আমার জানা ছিল না। নূর হোসেন যেরকম দৃপ্ত ভঙ্গীতে মিছিল করছিল, সেটা আমাকে আকর্ষণ করছিল।”
“সম্ভবত নূর হোসেনের জীবনের শেষ মূহুর্তগুলো আমিই বন্দী করেছিলাম ক্যামেরায়।”
১৯৮৮ সালে দিনু আলম কানাডায় চলে যান। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর তোলা সবগুলো ছবি তিনি এখনো সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো তিনি সবাইকে বিনামূল্যে ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছেন।
“আমার মনে হয়েছে এগুলো আমাদের ইতিহাসের অনন্য দলিল। এই ছবি তাই আমি সবার সঙ্গে শেয়ার করেছি।”
১০ নভেম্বর মধ্যরাতে জুরাইন গোরস্থানের গেটে এসে থেমেছিল কয়েকটি গাড়ি। গোরস্থানের নৈশ প্রহরী মোহাম্মদ আলমগীর গেট খুলতে অস্বীকৃতি জানালেন।
“রাত এগারোটার পর আমরা লাশ দাফন করি না”, বলেছিলেন তিনি।
“আমরা সরকারের লোক”, জানালেন গাড়ি থেকে নামা একজন।
মোহাম্মদ আলমগীরের মনে আছে, গাড়িতে ছিল অনেক সেনা, সঙ্গে পুলিশ। পেছনে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে তিনটি লাশ।
মোহাম্মদ আলমগীরকে খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আমাকে। প্রায় তিন দশক জুরাইন কবরস্থানে কাজ করার পর, সম্প্রতি তিনি বদলি হয়ে এসেছেন মোহাম্মদপুরের বসিলা গোরস্থানে। এখানেও নৈশ প্রহরীর কাজই করেন তিনি।
“কিন্তু আমি যখন জুরাইনে কাজ করতাম, তখন পাহারাদারের কাজ ছাড়াও কবরে মাটি দেয়া, গোসল করানো- সব কাজই করতে হতো।”
সেদিন তার দায়িত্ব পড়েছিল লাশগুলোকে গোসল দেয়া। সব কাজ শেষ করে লাশগুলো মাটি দিতে দিতে ফজরের আজানের সময় হয়ে গিয়েছিল।
“গোসল দেয়ার সময় দেখি, একটা লাশের গায়ে সাদা রঙ দিয়ে কিছু লেখা। লাশের বুকের নীচে পেটের কাছে গুলিটা লাগছিল। লেখাটার ঠিক নীচে। আমি অনেক চেষ্টা করছি, রঙটা উঠে নাই। পরে এই লেখা সহ আমরা লাশটা কবর দিছি।”
সেদিন যে তিনটি লাশ তারা কবর দেন, সেগুলি কয়েকদিন পাহারা দিয়েছিল পুলিশ।
কয়েকদিন পর নূর হোসেনের পরিবার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিল জুরাইন কবরস্থানে।
মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, “ওরা আইসা খুব কান্নাকাটি করতেছিল। তাদের পোলার লাশ কোথায় কবর হইছে, জানবার চায়। আমি তো আর জানি না নূর হোসেন কোন জন। হেরা কইলো আমাদের পোলার বুকের মধ্যে সাদা রঙের লেখা ছিল। আমি তো আর লেখা-পড়া জানি না, তখন যেই কবরে ঐ লাশ কবর দিছি, ঐ কবরটা দেখাইছি।”
যে শ্লোগান নূর হোসেনের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়, শেষ পর্যন্ত সেই শ্লোগানের মাধ্যমেই ছেলের কবর চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তার বাবা-মা।
১১ই নভেম্বর সকালে ইকরাম হোসেন যখন সংবাদপত্রের পাতায় নূর হোসেনের ছবি দেখেছিলেন, তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো।
“যখন আমি বুঝতে পারলাম, নূর হোসেন মারা গেছে। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আমার মনে হলো, নূর হোসেন নিহত হওয়ার জন্য আমিই দায়ী। আমার জন্যই ছেলেটা মারা গেছে।”
নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান লিখে দেয়ার গল্পটা ইকরাম হোসেন শুধু করেছিলেন তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর কাছে। তাদেরকে তিনি অনুরোধ করলেন এই ঘটনা কাউকে না জানানোর জন্য। তিন বছর তিনি পালিয়ে পালিয়ে ছিলেন।
“যদি তখন আমার নাম কেউ প্রকাশ করতো, আমার পুরো পরিবারকে জেনারেল এরশাদ বন্দী করতেন। আমার ভাই তখনো প্রেসিডেন্টের চাপরাশি।”
প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে দুজন সাংবাদিক তার কাছে এলেন। সেই প্রথম সবাই জানলো, তিনিই নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান একেঁ দিয়েছিলেন।
সে বছরই নূর হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে জুরাইন গোরস্থানে এক অনুষ্ঠানে ইকরামের সঙ্গে দেখা হয় আলি হোসেনের। ইকরাম তাকে খুলে বললেন সব কাহিনী।
সেদিন সন্ধ্যাতেই তিনি আলি হোসেনের সঙ্গে গেলেন তাদের বনগ্রাম রোডের বাসায়। সেখানে তার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো নূর হোসেনের বাবা মুজিবুর রহমানের।
“আমি উনাকে বললাম, আমার দোষে আপনার ছেলে শহীদ হয়েছে। আমি অপরাধী। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার এক ছেলে মারা গেছে। কিন্তু তুমিও তো আমার এক ছেলে। তুমি কোন অন্যায় কর নাই। তখন আমার মাথা থেকে যেন একটি বোঝা নেমে গেল। আমার বুকটা যেন হালকা হলো।”
১৯৮৭ সালের এই আন্দোলন জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তিন বছর পর আবারও এরকমই আরেকটি গণবিক্ষোভের মুখে তার পতন ঘটে।
পদত্যাগের পর তাকে কারাবন্দী করা হয়। দুর্নীতির মামলায় তাকে সাজা ভোগ করতে হয়।
১৯৯৭ সালে তিনি মুক্তি পেলেন জেল থেকে। মুক্তির পর তিনি নূর হোসেনের পিতা-মাতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বনগ্রাম রোডের বাড়িতে।
আলী হোসেন জানান, “জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটি পাজেরোতে চড়ে উনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার বাবা মার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমার বাবাকে বললেন, আপনার ছেলে থাকলে আপনার জন্য যা করতো, আমি তাই করবো। আমি ক্ষমা-প্রার্থী। এটা ভুল হয়েছে।”
এরপর বহু বছর জেনারেল এরশাদ যোগাযোগ রক্ষা করে গেছেন নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে।
কিন্তু তারপর আবার সেই সম্পর্কে ছেদ ঘটলো।
“একবার আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের এক সভায় গিয়ে বলেছিলেন, এদেশে যেন আর স্বৈরাচারের জন্ম না হয়। এটা শুনে এরশাদ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি আব্বাকে বলেছিলেন, আপনি আবার আমাকে স্বৈরাচার বললেন? তখন থেকে এরশাদ আর আব্বার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।”
যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল এবং নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য যাকে দায়ী করা হয়, তার সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ এক দশকেরও বেশি পরে।
জেল থেকে বেরিয়ে তিনি তখন তার দলকে চাঙ্গা করতে সারাদেশ সফর করছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নদীপথে লঞ্চে করে এরকম এক সফরে তার সঙ্গী হয়েছিলাম আমরা এক দল সাংবাদিক।
জেনারেল এরশাদের একজন সহকারী তাকে জানিয়েছিলেন, ছাত্র জীবনে আমি তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলাম।
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে তিনি আমাকে রসিকতা করে বললেন, “শুনলাম তুমি নাকি বিপ্লবী ছিলে।”
একজন সামরিক শাসক হিসেবে যেরকম রাশভারী মানুষ বলে আমি তাকে কল্পনা করেছিলাম, বাস্তবে তার সঙ্গে পার্থক্য ছিল। তার ছিল মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেশার ক্ষমতা, তিনি তার কথা দিয়ে মানুষকে আকর্ষণ করতে পারতেন।
কিন্তু এটি ছিল তার চরিত্রের একটি দিক মাত্র। তার ছিল অনেক চেহারা।
১৯৮২ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। সারা বিশ্বে সামরিক শাসকরা যেসব কথা বলে ক্ষমতা দখল করেন, তিনিও সেসব কথাই বলেছিলেন।
তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, সরকারি প্রশাসনে সংস্কার আর রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার অঙ্গীকার করেছিলেন।
কিন্তু নিজের ক্ষমতাকে সংহত করতে আর ধর্মীয় রক্ষণশীলদের মন জয় করতে তিনি ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে তিনি পরিবর্তন করেছিলেন।
নিজেকে কবি বলে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি উদগ্রীব ছিলেন, কিন্তু নিজের নামে পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া এসব কবিতা তিনি নিজে লিখতেন, নাকি অন্য কেউ লিখে দিতেন সেটা নিয়ে অনেক গুজব ছিল।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম সরকার প্রধান, যাকে দুর্নীতির দায়ে সাজা-ভোগ করতে হয়েছিল।
২০১৯ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাকে প্রতিনিয়ত আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে আরও অনেক মামলায়।
তিরিশ বছর আগে, ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটেছিল এক গণ আন্দোলনের মুখে। সেদিন ঢাকা এবং সারা বাংলাদেশে যে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, তা ছিল অভূতপূর্ব।
হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিল, তারা আনন্দে নাচছিল, গান গাইছিল, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছিল।
সেদিনের এই উল্লাস-আনন্দের কথা আমি এখনো মনে করতে পারি।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এমন দৃশ্য সম্ভবত আর দেখা যায়নি।
মনে হচ্ছিল বাংলাদেশে এক নতুন সূর্য উঠেছে, নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে।
কিন্তু এই আনন্দ ছিল ক্ষণস্থায়ী।
জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়েছিল যে দুটি প্রধান দল, সেই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে এবার শুরু হলো ক্ষমতার লড়াই।
পরবর্তী দশকগুলোতে পালাক্রমে এই দুই দলের শাসনই দেখেছে বাংলাদেশ। ক্ষমতায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য তারা পুরনো শাসকের কৌশলগুলোকেই ব্যবহার করেছে।
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে যে রাজনৈতিক কর্মীরা নানাভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন, তাদের অনেকেই বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রত্যাবর্তনে ব্যথিত।
১৯৯০ সালের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, নাসির-উদ-দোজা ছিলেন তার একজন প্রথম সারির নেতা।
তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৮৭ সালে এক অদ্ভুত জায়গায়, গ্রেফতার হওয়ার পর একটি পুলিশ লরিতে। আমাদের নিয়ে লরিটি যখন শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দিকে ছুটছে, তখনো চলন্ত গাড়িতেই পুলিশ তাকে লাথি মেরে যাচ্ছিল।
কারাগারে যখন আমাদের পাশের সেলে নূর হোসেনের গুলিবিদ্ধ লাশ ফেলে রাখা হয়, তখন সেখানেও এক সঙ্গে ছিলাম আমরা।
নাসির-উদ-দোজা এখন থাকেন কানাডার টরোন্টোতে। যে দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা জেনারেল এরশাদের পতন ঘটান, সেটি নিয়ে এখনও তিনি গর্বিত।
“এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল, এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব ছিল। সামরিক শাসনের কবর রচনা করে আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথ তৈরি করেছিলাম।”
কিন্তু সেই গণতন্ত্রের এখন যে অবস্থা, সেটা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ।
“আমাদের প্রজন্মের আমরা আমাদের পুরো যৌবন বিসর্জন দিয়েছি। আমাদের তারুণ্যের প্রেম বিসর্জন দিয়েছি। ভালোভাবে পড়াশোনা করে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছি। কেন? আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।”
“নিজেদের ক্ষুদ্র দলীয় আর ব্যক্তি স্বার্থে আমাদের নেতা-নেত্রীরা আমাদের সেই স্বপ্নকে হত্যা করেছেন। আমি তাদেরকে ক্ষমা করতে পারবো না।”
৩৩ বছর আগের সেই নভেম্বরের কথা মনে পড়লে আলি হোসেন এখনো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে এরশাদে পতনের পরের বছরগুলোতে যা ঘটেছে, সেটি তাকে বেশ ক্ষুব্ধ করে।
“প্রথম কয়েক বছর আমরা গণতন্ত্র দেখেছিলাম। রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যেমন, যেন সেরকম। সেই গণতন্ত্র এখন কোথায়”, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করেন তিনি।
আলি হোসেনের বয়স এখন ৫২। তিনি এখনো একজন সাইনবোর্ড আর্টিস্ট হিসেবেই কাজ করেন।
১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর তিনি তার নতুন দোকান খোলেন হাটখোলা রোডে। মতিঝিলের যে গলিতে তিনি নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান এঁকে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে বেশি দূরে নয় তার নতুন দোকান ‘আর্ট হেভেন।’
যখন তিনি সাইনবোর্ড লেখক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন রং আর তুলি নিয়েই ছিল তার কাজ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। তুলি দিয়ে হাতে আর লিখতে হয় না, এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে।
“সেই যুগে তো ডিজিটাল বলে কিছু ছিল না। আমাদের সব হাতেই লিখতে হতো। আমার এই জীবনে শত শত সাইবোর্ড লিখেছি, ব্যানার লিখেছি।”
“যেদিন নূর হোসেনের শরীরে শ্লোগান লিখি, সেদিন কাজটা করেছিলাম খুব তাড়াহুড়ো করে। আমার হাত কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমরা যে সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান লিখছি, কেউ দেখে ফেলবে। আমার লেখা সেদিন বেশি সুন্দর হয়নি। কিন্তু আমি বলবো আমার জীবনের সেরা কাজ ছিল সেটি।”
আলি হোসেন এখন আর নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান লেখার জন্য অনুতপ্ত নন।
“যদি আমি ৩৩ বছর আগে ফিরে যেতে পারি, এই কাজ আমি আবারও করবো”, বলছেন তিনি।
এসএইচ-০৫/০৬/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র : বিবিসি)