মাঠ প্রশাসনে চরম বিরোধ!

সরকার বিরোধী রাজনীতিকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাও মাঝে মধ্যে আমলাদের ‘বাড়াবাড়ির’ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা নেই। মন্ত্রীরাও প্রায় একই সুরে অভিযোগ তুলেছেন। মূলত মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের পরোক্ষ দ্বন্দ্ব ও দূরত্বের কারণে মাঝে মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির খবর পাওয়া যায়। কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই একটা দোটানায় থাকে। জন প্রতিনিধিদের অভিযোগ, কর্মকর্তারা তাদের কথা আমলে নিতে চান না।

কর্মকর্তাদের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিরা তাদের ক্ষমতার পরিধি ভুলে গিয়ে সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে চান। এমন প্রেক্ষাপটে জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সব পক্ষই দায়িত্বশীল আচরণ করলে বিরোধ কর্মে কার্যকর মাঠপ্রশাসন গড়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মাঠ প্রশাসনের বিরোধ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের বক্তব্য হচ্ছে, সবাইকে এখতিয়ারের মধ্যে থেকে আচরণ করতে হবে। তিনি বলেন, তাদের যে কাজের গন্ডি সংবিধানে দেওয়া, দায়িত্বের মধ্য থেকেই সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

গত ১৯ আগস্ট রাতে বরিশালে ইউএনওর বাসায় হামলার অভিযোগে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে হুকুমের আসামি করে দুটি মামলা হয়। অন্যদিকে, ইউএনও এবং ওসিসহ ৩০-৪০ জনকে আসামি করে পাল্টা মামলা হয়। ওই ঘটনায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন মেয়র ও তার সহযোগীদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়। ওই বিবৃতির পর প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে অবশ্য স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মেয়রের সমঝোতা হয়। ওই ঘটনায় রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও আমলাদের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।

করোনা মহামারী প্রতিরোধে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম সুসমন্বয় করতে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয় সরকার। এ নিয়েও সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীরা কঠোর সমালোচনা করেন।

গত বছর ফরিদপুরে চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনের সময় ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ডিসি ও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে ইউএনওকে এমপি নিক্সন চৌধুরী গালাগালি করতে শোনা যায়। ওই ঘটনায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নিক্সন চৌধুরীকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানায়। মামলাও হয় নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, আসলে সত্যি কথা হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের বিরোধ কিন্তু সংঘবদ্ধ কোনো ঘটনা নয়। ৬৪ জেলায় প্রায় ৪৯২ উপজেলা আছে। এখন কোথাও যদি ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নিয়ে কর্মকর্তার সঙ্গে সেখানের জনপ্রতিনিধিদের বিরোধ হয়, তাহলে সেটাকে সংঘবদ্ধ ঘটনা বলা যাবে না। এক সঙ্গে কাজ করতে গেলে টুকটাক মনোমালিন্য বা বিরোধ হতেই পারে। দিনশেষে কর্মকর্তা-রাজনীতিক মিলেই দেশের জন্য কাজ করেন। একসঙ্গে বসবাস করলে ভাইবোনদের মধ্যেও তো বিরোধ হয়। এগুলো মেনে নিয়েই চলতে হবে।

তিনি আরও বলেন, মনে রাখবেন কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা ইউএনও-ডিসি পরিকল্পনা করে কোনোদিনই বিরোধে জড়ান না। জনপ্রতিনিধিরা মানুষের ভোটে নির্বাচিত হন। তারা মানুষের কাছে নানা প্রতিশ্রুতি দেন। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে অনেক সময়ই বেগ পেতে হয়। ফলে কোনটা এখতিয়ারের মধ্যে, কোনটা এখতিয়ারবহির্ভূত তারা তা অনেক সময়ই বিবেচনায় নিতে পারেন না। কিন্তু কর্মকর্তারা সরকারের আইনকানুনের মধ্যে থেকেই কাজ করেন।

চট্টগ্রামে কাজ করে আসা একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বলেন, যেসব উপজেলায় চেয়ারম্যান ও এমপির মধ্যে সুসম্পর্ক আছে সেখানে ইউএনওর সঙ্গে কোনো ঝামেলা হয় না। কিন্তু যেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপির মধ্যে গ্রুপিং আছে সেখানে সাধারণত ইউএনও এমপির পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। কেউ কারও কথা শুনতে চান না। আর যেসব এলাকার জনপ্রতিনিধি মন্ত্রী হয়েছেন সেসব উপজেলায় ইউএনওর সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরোধ নেই বললেই চলে। কারণ মন্ত্রীর প্রভাবের কারণে অন্যরা ইউএনওর ওপর খবরদারি করার সাহস পান না। সেখানে মন্ত্রীর সঙ্গে ইউএনওর সম্পর্কও খুবই ভালো।

নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু বলেন, উপজেলায় চেয়ারম্যান একেবারেই ক্ষমতাহীন। বলতে গেলে আমাদের কোনো কাজই নেই। শুধু এডিপির ফাইল ছাড়া অন্য কোনো ফাইল আমাদের দপ্তরে আসে না। সমস্ত কাজ ইউএনও একাই করেন। তিনি আরও বলেন, উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) অনুযায়ী উপজেলায় থাকা ১৭টি দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের কাজ উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কিছু পরিপত্র জারি করে ওই ১৭টি দপ্তরে যেসব কমিটি করা হয়েছে সবগুলোর সভাপতি ইউএনওকে করা হয়েছে। আর উপদেষ্টা করা হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে। ফলে সভাপতি হিসেবে সব কাজই এককভাবে করেন ইউনএও।

আরও তিনজন উপজেলা চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যে উপজেলা পরিষদ ছিল তাতে চেয়ারম্যানদের প্রকৃত ক্ষমতা ছিল। তখন উপজেলার সব কাজই হতো চেয়ারম্যানের পরামর্শক্রমে। কিন্তু ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ আইনে চেয়ারম্যানদের কোনো ক্ষমতাই নেই। আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে রিট হয়েছে। হাইকোর্টের রায় চেয়ারম্যানদের পক্ষে এলে তারা কিছুটা হলেও জনগণের জন্য উদারভাবে কাজ করতে পারবেন।

অন্যদিকে সাবেক কয়েকজন ইউএনও অভিযোগ করে বলেন, টেন্ডার, বরাদ্দ ও ভূমি বন্দোবস্তের মতো বিষয়গুলো এমপি কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যানের পছন্দমতো না হলেই তারা কর্মকর্তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু সব সময় জনপ্রতিনিধিদের চাওয়া পূরণ করা ইউএনওদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে। চট্টগ্রামের একটি উপজেলার ইউএনও জানান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা কেন্দ্র করে অনেক সময় ইউএনওদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের বিরোধ হয়। কারণ যে কোনো বড় অভিযানই অনেক সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চলে যায়। এসব বিষয়ে ইউএনওরা ছাড় দিতে নারাজ। ফলে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

অভিযোগ আছে, উপজেলা চেয়ারম্যান বা এমপি বিরোধী দলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হলে তিনি ইউএনওর কাছে গুরুত্ব পান না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে দলেরই হোক তারা ইউএনওর কাছে গুরুত্ব না পেলে কিংবা ইউএনও তাদের কথা না শুনলে বিরোধ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে এমপিরা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এক সঙ্গেই চর্চা করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করেন।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এমপিদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করার পর থেকে কর্মকর্তাদের ওপর খবরদারি বেড়েছে। কোনো কোনো এমপি পরিষদ সভা কবে ডাকা হবে, সে নির্দেশও দেন। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইউএনওরা এমপিকে উপেক্ষা করতে পারেন না। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও এমপিরা এখন একই দলের হলেও নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বী।

তিনি আরও বলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের তাদের আইনগত প্রাপ্য মর্যাদা ও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা চলে না। উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হলেন চেয়ারম্যান। আর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন ইউএনও। তার সুনির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহি রয়েছে। সরকারের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করাও এর আওতায় পড়ে। সুতরাং কোনো ব্যয় অনুমোদন সুপারিশ করার আগে ইউএনওকে নিশ্চিত করতে হয় এর যথার্থতা সম্পর্কে। অবশ্য তা তিনি করবেন চেয়ারম্যানকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েই।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ইউএনওকে দিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নথি সই করিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো কোনো চেয়ারম্যানের চাপ দেওয়ার অভিযোগও আছে। অসৌজন্যমূলক আচরণেরও অভিযোগও আছে। উভয় পক্ষ পারস্পরিক আইনগত অবস্থান উপলব্ধি করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

এসএইচ-০৫/০৭/২১ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র : আমাদের সময়)