প্রশাসনের কর্তাদের স্যার, ম্যাডাম সম্বোধন নিয়ে বিতর্ক

দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের নাগরিকরা কী বলে সম্বোধন করবেন তা নিয়ে বিতর্ক অনেক আগে থেকেই। তবে তারা স্যার-ম্যাডাম শুনতেই অভ্যস্ত। আর এই সম্বোধন না পেলে তারা বিরক্ত হন এমনকি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কয়েকদিন আগে বলেছেন,”সরকারি সেবা নিতে আসা জনসাধারণকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো নীতি নেই।”

তিনি আরো মনে করিয়ে দিয়েছেন,” যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনসাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তবে তা দুর্নীতির শামিল। ”

তার এই কথার পর এখন স্যার-ম্যাডাম বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। এই নিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য আগেই অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেন সেই আলোচনা তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।

চলতি বছরের ৯ জুলাই মানিকগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে ম্যাডাম না বলে আপা বলায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তার সাথে থাকা পুলিশ। ইউএনও একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় এই ঘটনা ঘটে।

এই বছরেরই ৩০ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাস এক ব্রিফিং-এ সাংবাদিকরা তাকে ভাই বলায় চরম বিরক্ত হন। তিনি বলেন,” ‘আপনাদের ভাই বলে ডাকার রেওয়াজ আর গেল না, জানেন আমাদের এই চেয়ারে বসতে কত কষ্ট করতে হয়েছে?”

আবার গত এপ্রিলে নেত্রকোনার কালমাকান্দা উপজেলায় ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন।

এই রকম উদারহরণ আরো আছে। সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই সরকারি কর্মকর্তাকে স্যার না বলায় হেনস্তা করার খবর বের হয়।

তবে এটা যে সাধারণ মানুষের শুধু ঘটে তা নয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অধস্তনরাও স্যার স্যার বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম বলেন,”স্যার বলার এই রীতি আমরা পেয়েছি ঔপনিবেশিক আমল থেকে। কিন্তু বৃটিশরা চলে গেলেও আমাদের মনোভাব বদলায়নি। সরকারি কর্মকর্তারা স্যার বা ম্যাডাম সম্বোধন চান ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে।”

একজন জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,”সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সময় তাদের জনবান্ধব হওয়ার কথা বলা হয়। আর সম্বোধনের ব্যাপারে তাদের স্যার বা ম্যাডাম বলতে হবে এধরনের কোনো কথা বলা হয় না। বলা হয়, সাধারণ মানুষকে সম্মান করে তাদের কাছে সরকারের সেবা পৌঁছে দিতে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তারা স্যার বা ম্যাডামে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। মনে করেন এভাবেই তাদের সম্বোধন করতে হবে। আর এই বিষয়গুলো ব্যক্তির ওপরও অনেকটা নির্ভর করে।”

ডেপুটি কমিশনারের বাংলা করা হয়েছে জেলা প্রশাসক। আকসাদুল আলম বলেন,”এই বাংলা কীভাবে করা হলো তা আমি বলতে পারবনা। তবে এটাও আধিপত্যবাদী মানসিকতার প্রকাশ। সিভিল সার্ভেন্ট কীভাবে প্রশাসক হন! কোলকাতায় কিন্তু প্রশাসক জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ নেহাল করিম বিষয়টিকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন,” এই যারা স্যার বা ম্যাডাম সম্বোধনের দাবি করেন তারা এটা করেন হীনমন্যতাবোধ থেকে। তারা মনে করেন এটা না হলে তারা যে ক্ষমতাবান তা প্রকাশ পাবে না।”

তিনি জানান,”স্যার-ম্যাডাম এগুলো বৃটিশ কায়দা। তবে সেটা পারস্পরিক সম্মান জানানোর কায়দা। অ্যামেরিকাতে সেলসম্যানরা ক্রেতাকে স্যার-ম্যাডাম বলেন। কিন্তু আমাদের এখানে এটা সামন্ত মনোভাবের প্রকাশ। আমরা মনে করি স্যার-ম্যাডাম না বললে আমাদের সম্মান জানানো হল না।”

সাবেক সচিব র আ ম উবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী মনে করেন, স্যার-ম্যাডাম পারস্পরিক সম্মান জানানোর জন্য বলা হয়। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। এর প্রচলন সারা বিশ্বই আছে।তিনি বলেন,”আমার চাকরি জীবনে আমাকে কেউ স্যার বলেছেন কেউ ভাই বলেছেন। আমার কাছে সবই সমান মনে হয়েছে। আমিও কাউকে স্যার, কাউকে ভাই বলি। নেতাদের বলি লিডার। এটা সাহেব, জনাবও হতে পারে।”

তিনি দাবি করেন,” স্যার না বলায় ইউএনওরা হেনস্তা করেন বলে সংবাদমাধ্যমে যে খবর বের হয় তাকে আমি সঠিক তথ্যভিত্তিক মনে করিনা। আমি নিজেও ইউএনও ছিলাম। আমার ক্ষেত্রে তো এরকম ঘটেনি।”

তবে স্যার-ম্যাডাম নিয়ে দেশে কোনো ক্রাইসিস হয়েছে বলে মনে করেন না সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি মনে করেন, প্রশাসন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে গেছে এটা একটা বিষয়। তিনি বলেন,”সংবিধান অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। পাবলিক সার্ভেন্ট। এটা মনে রাখা জরুরি। আর স্যার-ম্যাডাম যেন পারস্পরিক সম্মান প্রকাশের ভাষা হয়। এটা যেন একপাক্ষিক না হয়। কাউকে এটা বলতে বাধ্য করা যাবে না।”

এসএইচ-০১/১০/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)