স্কুলে ফিরতে পারছে না অনেক শিক্ষার্থী!

দেশে দেড় বছর পর স্কুল-কলেজ খুলেছে৷ কিন্তু এই করোনার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ এজন্য পরিকল্পনামাফিক কৌশল হাতে নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের৷

ঝরে পড়ার প্রধান কারণ বলা হচ্ছে দারিদ্র্য৷ তাছাড়া বাল্য বিয়ে এবং তথ্য প্রযুক্তিতে গ্রামের শিক্ষার্থীদের তেমন অংশগ্রহণ না থাকার ফলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷

রবিববার স্কুল খোলার প্রথম দিনে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে গড়ে ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে৷ তবে কোনো কোনো স্কুলে ৮০-৯০ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন৷ কোথাও আবার ২০-৩০ ভাগ৷ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা গেছে৷

পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নীতি ঠিকমত না মানায় আজিমপুর গার্লস স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷

তবে গ্রামাঞ্চলের অনেক স্কুল বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় খোলা জায়গায় ক্লাস নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷ আবার অনেক স্কুলে সাঁকো ও নৌকা দিয়ে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ক্লাসে হাজির হতে হয়েছে৷ দেড় বছর পর স্কুল খোলার উদ্বেগের বিষয় হলো যে, শেষ পর্যন্ত কতভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরতে পারবে৷

এরইমধ্যে করোনাকালে ড্রপআউট (ঝরে পড়া) শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি৷ জানা গেছে, অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিতি সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় এ তালিকা করা হয়৷

মংলা উপজেলা শিক্ষা অফিসার (প্রাথমিক) সুমন্ত পোদ্দার জানান, ‘‘আমাদের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তাতে প্রাথমিকে শতকরা ৫০ ভাগের মত ড্রপ আউট দেখানো হয়েছে৷ এখন আমরা এটা সরেজমিন পরীক্ষা করে দেখছি৷ তবে এই সংখ্যা এত হবেনা৷ কারণ তাদের জরিপে ভুল আছে৷ এখন পর্যন্ত যা পেয়েছি তাতে ১৫-২০ ভাগ হবে৷ আমরা এখনো প্রতিবেদন পাঠাইনি৷ কাজ শেষ করতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে৷”

দেশের ৬৪ জেলার ৩৪৫টি উপজেলা, সব সিটি কর্পোরেশন এবং ১৫টি শহরে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে৷

বেসরকারি সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযান তাদের ‘এডুকেশন ওয়াচ’ রিপোর্টে বলেছে, করোনার সময় দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শকরা ৬৯.৫ ভাগ শিক্ষার্থী অলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি৷ টেলিভিশনে প্রদান করা ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতে পারেনি অনেকে৷ অংশগ্রহণ না করার এই হার শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি৷ তাদের জরিপ বলছে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া এবং অনুপস্থিতি বাড়বে৷

এদিকে করোনার সময়ে দেশের অনেক কিন্ডারগার্টেন এবং নন-এমপিও স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে৷ এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ দেশে বাংলা মাধ্যমের কিন্ডার গার্টেন আছে ৪০ হাজার৷ এর বেশিরভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলে৷ এরমধ্যে করোনার সময়ে আর্থিক দুরবস্থার কারণে ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে৷

বাংলাদেশ কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জিএম জাহাঙ্গীর কবির রানা বলেন, ‘‘এগুলো ইংশিশ স্কুল নয়৷ নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং গরিব ঘরের সন্তানরাই এইসব কিন্ডার গার্টেনে পড়াশুনা করে৷ বন্ধ হয়ে যাওয়া এই ১০ হাজার স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে কিনা সন্দেহ৷ আর আজকে (রবিবার) চালু স্কুল গুলোতে সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলো৷’’

বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, করোনায় বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে৷ আগে এটা ছিলো ২০.৫ শতাংশ৷ চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছেন ২৮.৫ শতাংশ মানুষ৷ করোনায় বাল্য বিয়েও বেড়েছে৷

এই সবগুলোর অভিঘাতই পড়েছে শিক্ষার উপর৷ বাংলাদেশে সাধারণভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ড্রপআউট শতকরা ১৭ ভাগ৷ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৭ ভাগ৷ করোনায় এটা বাড়বে৷ তাই পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও আগামী শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যের ৭৭ লাখ বই কম ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, দারিদ্র্যের কারণে ড্রপআট তেমন বাড়বেনা৷ কারণ দরিদ্র হলেও বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে৷

তবে তিনি বলেন, ‘‘করোনার সময় বাল্য বিয়ে বেড়ে যাওয়া, পড়াশুনার অভ্যাস নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং সবার কাছে তথ্য প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ও গ্যাজেট না থাকার কারণে ড্রপআউট বাড়তে পারে৷’’

তার মতে, যাদের তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা ছিলো তারা অনলাইনে ঠিকমত শিখতে পারেনি৷ যাদের ছিলোনা তারা তো শিখেইনি৷ আর এই দেড় বছর ঘরে থাকার কারণে অনেকের লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে৷ করোনায় স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে ঘরে বসিয়ে না রেখে অনকে বিয়ে দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে দিয়েছে৷ ফলে এসব নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ না করলে ড্রপআউট ঠেকানো যাবেনা৷

এসএইচ-০২/১৩/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)