আইন ও নীতিমালার কারনে সুযোগ নিচ্ছে প্রতারকরা!

দেশে ই-কমার্সের নামে আর্থিক প্রতারণায় এখন আলোচনার তুঙ্গে আছে ইভ্যালি৷ প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোহাম্মদ রাসেল সস্ত্রীক গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ তাদের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে৷ এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ তাদের ‘ধামাকা’ জাতীয় উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে নানা অফারে যারা টাকা দিয়েছেন তাদের এখন মাথায় হাত৷ তারা অফিসের সামনে এখন জড়ো হচ্ছেন তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য৷ তাদের কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করছেন রাসেলকে ছেড়ে দিলে তারা টাকা ফেরত পাবেন৷ তাই তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনও করা হচ্ছে৷ কিন্তু ইভ্যালি টাকা ফেরত দেবে কীভাবে? তাদের সম্পদ আছে ৬৫ কোটি টাকার৷ আর দায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি৷

এরসঙ্গে আরো একটি উদাহরণ দেয়া যাক৷ পিরোজপুরের এহসান গ্রুপ হালাল ব্যবসার কথা বলে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের সম্পদের পরিমান খুব সামান্যই৷ তাদের যে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো সাইনবোর্ড সর্বস্ব৷

ই-কমার্সের নামে ইভ্যালি ছাড়াও আরো নয়টি প্রতিষ্ঠান প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত৷ তাদের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রতারণা ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে৷ ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়৷

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত নানা ধরনের ব্যবসার নামে প্রতারকরা ২১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে৷ এইসব প্রতারক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় হালের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আছে ডেসটিনি, যুবক, ইউনি পে টু ইউ ও নানা ধরনের কথিত সমবায় প্রতিষ্ঠান৷

বহুল আলোচিত ডেসটিনির মালিক রফিকুল আমিনের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের পর তিনি গ্রেপ্তার হন৷ তিনি দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও প্রতারিতরা তাদের টাকা ফেরত পাননি৷ যুবক ও ইউনি পে টু ইউ-এর গ্রাহকদেরও একই অবস্থা৷

এই পরিস্থিতি কেন? এটার জন্য আইনি ব্যবস্থার দিকে তাকানো যাক৷ ইভ্যালি ও এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় মামলা হয়েছে৷ বাংলাদেশে প্রতারণা বা আর্থিক প্রতারণার মামলা এই দুইটি ধারাতেই হয়৷ ৪০৬ ধারায় বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ৷ যার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড৷

আর ৪২০ ধারায় প্রতারণা ও আর্থিক প্রতারণা৷ যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড৷ দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম জানান,”দণ্ডবিধির এই মামলায় প্রতারিতদের অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো বিধান নাই৷ আদালতে অপরাধ প্রমাণ হলে রাষ্ট্র সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে৷ আর এটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার৷”

তিনি বলেন, দেওয়ানী মামলা করে প্রতারিতরা অর্থ ফেরত পেতে পারেন৷ কিন্তু সেই মামলা প্রমাণ করে আদলতের মাধ্যমে অর্থ ফেরত পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়৷ এত ধৈর্য অনেকেরই থাকে না৷ আর দুদক মানিলন্ডারিং-এর মামলা করে প্রতারকদের ব্যাংক একাউন্ট ও সম্পদ জব্দ করলে প্রতারিতরা তা থেকে অর্থ ফেরত পেতে পারেন৷ কিন্তু যারা প্রতারিত তাদের প্রমাণ করতে হবে তিনি কী পরিমাণ টাকা দিয়েছেন৷”
তবে প্রতারকদের সম্পদ বা হিসাবে কত টাকা আছে তা বিবেচনার বিষয়৷ টাকা না থাকলে ফেরত হবে কীভাবে?

খুরশিদ আলম বলেন,”রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপুরণের বিধান নেই৷ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলে নীতিমালা তৈরি করে যাতে কেউ প্রতারিত না হয় তার ব্যবস্থা করা৷ ই-কমার্সের নীতিমালা শেষ পর্যায়ে করে আরো বিপদ হয়েছে৷ তখন অনেকেই বিশ্বাস করে গ্রাহক হয়েছে৷ তবে আইন করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা করা যায়৷”

দেশে ই-কমার্স তথা স্টার্টআপ কোম্পানি নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ধারণা স্বচ্ছ নয়৷ তাই এই ধরনের বিপর্যয় ঘটছে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক৷ ফলে আইন ও নীতিমালা যা করা হচ্ছে তাও যথার্থ নয়৷ একটি স্টার্টআপ কোম্পানি শতকরা কত ভাগ দায় নিতে পারবে তার কোনো নীতি এখানে নেই৷

আর এই সুযোগ নিচ্ছে প্রতরকেরা৷ প্রতারিত গ্রাহকেরাও কোনো ক্ষতিপুরণ পান না৷ তিনি বলেন,”দণ্ডবিধিতে প্রতারতিদের অর্থ ফিরে পাওয়ার কোনোই সুযোগ নেই৷ আর মান্ডিলন্ডারিং মামলায় যিনি প্রতারিত তাকে চিহ্নিত করতে হবে যে কোন একাউন্টে তার কাছ থেকে নেয়া টাকা জমা আছে৷ কিন্তু টাকা আছে ৩০ লাখ৷ গ্রাহকদের পাওনা ৩০ কোটি৷”

এই ধরনের ঘটনায় দেওয়ানী মামলা করে টাকা পাওয়ার কোনো নজীর নেই৷ আর কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করে পাওনাদারদের তালিকা করে টাকা পাওয়া সম্ভব৷ কিন্তু সেখানেও একই কথা৷ টাকা তো থাকতে হবে?

তার মতে, এইসব কারণেই বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত প্রতারিতরা টাকা ফেরত পান না৷ আর ইভ্যালিসহ অন্যান্য প্রতারক প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রতারিতদের টাকা ফেরত পাওয়ার আশা দেখছেন না তিনি৷

এসএইচ-০১/২১/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)