প্রতারকদের অভয়ারণ্য বাংলাদেশ!

ইভ্যালির পর একটার পর একটা প্রতারণার খবর বের হচ্ছে। এই প্রতারণা হচ্ছে নানা কৌশলে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারকেরা নিয়ে গেলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা রেহাই পেয়ে যাচেছ।

আইন ও ই-কমার্স বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখানে রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব আছে। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন না করায়ই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে। তারা শাস্তি না পাওয়ায় প্রতারকেরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।

এখানে ব্যাংক, বিমা, লিজিং কোম্পানি আর এমএলএম ব্যবসার নামে প্রতারণার পর হালে ই-কমার্স প্রতারণা আলোচনায়। এর সাথে ধর্মকে ব্যবহার করেও নতুন করে প্রতারণা চলছে। আরো আছে ই-টিকিট, আইডি ব্যবসার মত প্রতারণা। রিং আইডি নামের সর্বশেষ যে প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির নাম এসেছে তারা তাদের আইডি বিক্রি করে বিজ্ঞাপনের লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করেছে। আর রাজারবাগের পীর সুন্নতি খাটিয়াসহ নানা পণ্যের সঙ্গে ইসলামের নাম দিয়ে প্রতারণা করেছে। পিরোজপুরের এহসান গ্রুপ প্রতারণা করেছে সুদ বিহীন হালাল ব্যবসার নামে।

এখন পর্যন্ত ই-কমার্সের নামে নামে সাধারণ মানুষের প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ই-অরেঞ্জ এক হাজার ১০০ কোটি টাকা, ইভ্যালি এক হাজার কোটি , রিং আইডি এক হাজার কোটি, ধামাকা ৭৫০ কোটি , সিরাজগঞ্জ শপ ৬০০ কোটি, ফাল্গুনি শপিং ডটকম ৫০০ কোটি, আদিয়ান ডটকম ৪৫০ কোটি, এসসিপি ২৬৮ কোটি, কিউ কম ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আরো কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান ৩০ থেকে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সবশেষ জানা গেছে সিটি বাজারের নাম। তারা ৩০ হাজার গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করেছে। টাকার পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। আর এহসান গ্রুপ হালাল ব্যবসার নামে নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।

এর আগে ২০১০ সালে শেয়ার বাজার থেকে ৪১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে। এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি হাতিয়ে নেয় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, ইউনিপে টু ইউ ছয় হাজার কোটি ও যুবক দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

বিভিন্ন সময় কো-অপারেটিভ ব্যাংক বা সমবায় সমিতির নামে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এইসব ঘটনায় মামলা হয়। প্রতারকেরা গ্রেপ্তারও হয়। কিন্তু প্রতারিতরা টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো নজির নাই। আর বাংলাদেশের আইনই প্রতারকদের সুবিধা করে দিয়েছে।

শেয়ার বাজার ছাড়া আর যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে সেগুলো খোলা বা পরিচালনার জন্য কোনো নীতিমালা বা আইন নাই। সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে বা রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ-এর নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। আর যখন প্রতারণা হয় তখন যে আইনে মামলা হয় তাতে শাস্তির বিধান আছে কিন্তু প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো কার্যকর আইন নাই। শাস্তির বিধান থাকলেও এই ধরনের প্রতারণায় ব্যাংক ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের কেউ শাস্তি পেয়েছেন এমন নজিরও নেই।

এই ধরনের ঘটনার বাংলাদেশে মামলা হয় দণ্ডবিধির ৪০৬ এবং ৪২০ ধারায়। ৪০৬ ধারায় বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড। আর ৪২০ ধারায় প্রতারণা ও আর্থিক প্রতারণা। যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড।

আইনজীবী ব্যরিস্টার মাহবুব শফিক বলেন,”আইন ও নীতিমালা না থাকায় এভাবে বছরের পর পর প্রতারণা চলছে। ফৌজদারি আইনে হয়তো কারাদণ্ড হবে কিন্তু প্রতারিতরা টাকা ফেরত পাবেন না।”

তিনি জানান, দেওয়ানি মামলা করে টাকা পাওয়ার বিধান আছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে টাকা পাওয়ার কোনো নজির নেই। কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করে পাওনাদারদের তালিকা করে টাকা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু টাকা তো থাকতে হবে? দুদক মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু টাকা তো নেই।

তিনি বলেন,” নীতিমালা না থাকা এবং মনিটরিং না করার সুযোগ নিয়েছে প্রতারকেরা। ই-কমার্স কোম্পানি করতে পেইড আপ ক্যাপিটাল থাকতে হয়। আর তার বিপরীতে কত দায় নিতে পারবে তাও হিসাব করে দেয়া হয়। ভারতেও এটা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে কিছুই নেই।”

তার মতে এখন নতুন আইন করে সেখানে ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তিনি বলেন,”এখানে বণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।

বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন,”এখানে বড় দায় ও দায়িত্ব সরকারের। সরকারের মনিটরিং থাকা দরকার এবং মানুষকে আগাম সতর্ক করতে হবে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান যাতে খুলতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর খুললেও যেন সাথে সাথে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। থাকতে হবে নীতিমালা। ইভ্যালির ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার পর আবার খুলে দেয়া হল। তাহলে মানুষ তো মনে করবে ঠিক আছে। এখানেই তো প্রতারণার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হল।”

তিনি বলেন,” প্রতারকেরা শাস্তি পায় না। তারা বারবার ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে আরো নতুন প্রতারক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ইভ্যালির বিরুদ্ধে দেড় বছর আগে থেকেই আমরা বলেছি। তখন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে এখন দেখা যাচ্ছে তাদের দেখে আরো ছোট-বড় অনেক প্রতারক প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে।”

তার মতে, মানুষকেও তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো সচেতন হতে হবে। কিন্তু সেটা তো সরকারকেই করতে হবে।

এসএইচ-২০/০৭/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)