জ্বালানি গ্যাস এলপিজি’র দাম বাড়ায় ভোক্তারা বিপাকে

প্রায় এক দশক ধরে রান্নার কাজে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করেন শরীয়তপুরের একজন গৃহবধূ রানি আক্তার। তিনি বলছিলেন, যেভাবে পাল্লা দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ছে, তার সাথে তাল মেলাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।

তিনি বলছেন,”প্রথমে একেকটা সিলিন্ডার কিনতাম সাড়ে তিনশো টাকা করে। সেটা এখন হাজার টাকার ওপরে। বাজারের সব জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে যদি এটার দামও বাড়তে থাকে, তাহলে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের তো খুব কষ্ট হয়ে যায়।”

”দাম বাড়লে যে ব্যবহার কমাবো বা বাদ দিবো, সেই উপায় তো নেই। বাসায় যেটুকু দরকার, তা তো লাগবেই। এখন দাম বাড়লেও কষ্ট করে চলতে হবে,” তিনি বলছেন।

বাংলাদেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির মূল্য রবিবার প্রতি কেজিতে প্রায় ১৯ টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা আগের দরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। প্রতি কেজি এলপিজির মূল্য আগের ৮৬ টাকা ০৭ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৪ টাকা ৯২ পয়সা।

এর ফলে ১২ কেজির একেকটি সিলিন্ডারের মূল্য আগের ১০৩৩ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২৫৯ টাকা। গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির দাম ৫০ টাকা ৫৬ পয়সা থেকে হচ্ছে ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা।

আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করতেই এই মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের।

গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

কমিশনের সদস্য মোঃ মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলছেন, কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এলপিজির নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে।

তিনি বলছেন, ”গত এপ্রিলে যখন গ্যাসের দাম ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা নিয়ে এলপিজি অপারেটরদের কিছু আপত্তি ছিল। আগের দাম যেহেতু গণ শুনানির করে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তাই তাদের আপত্তির পরে গত মাসের ১৪ তারিখে একটা গণ শুনানি করা হয়েছিল।”

” দ্বিতীয় আরেকটা কারণ হলো, আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস (সিপি) প্রতি মাসে ঘোষণা করা হয়, সেটা প্রায় প্রতিমাসেই ওঠানামা করে। তাই আমাদেরও সেটার সঙ্গে মিল রেখে মূল্য ঠিক করতে হয়। এসব কারণে নতুন করে দর নির্ধারণ করতে হয়েছে।”

এপ্রিল থেকে গত চারমাসে চারবার এলপিজির দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের কারণে এই বছরেই দুইবার শুনানি করে দাম বৃদ্ধি করা হলো।

কিন্তু সিলিন্ডার গ্যাসের এরকম মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ফরিদপুরের হামিদা আক্তারের মতো অনেকে।

হামিদা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ”যারা বাসায় পাইপের গ্যাস পায়,তারা যেভাবে ইচ্ছামতো খরচ করে। আর আমরা সিলিন্ডারের গ্যাস কিনে এতো হিসাব করে খরচ করি, তারপরেও তাদের চেয়ে আমাদের গ্যাসের পেছনে বেশি টাকা দিতে হয়। এটা তো ঠিক না।”

তিনি বলছেন, এখন শহরে বা গ্রামে তাদের মতো অনেক পরিবার রান্নার কাজে পুরোপুরি এলপিজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে এই অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দর বৃদ্ধি মানেই সংসারের বাজেটের ওপর চাপ তৈরি করা।

বাংলাদেশে রান্নার কাজে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার গত কয়েক বছরে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এখন গ্রামীণ এলাকাতেও এই সিলিন্ডারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। শিল্প ও আবাসিক মিলিয়ে বছরে দেশটিতে ১২ লাখ মেট্রিকটনের বেশি এলপিজি ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪১ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহার করেন।

ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দর সমন্বয়ের কথা বলা হলেও বাংলাদেশে এলপিজির দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

ক্যাবের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলছেন, ”ব্যবসায়ীরা যেভাবে পরিবর্তনটা চেয়েছে, এই মূল্যহারের পরিবর্তনে সেটাই নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু ঊর্ধ্বগতি আছে, তার সাথে দর সমন্বয় করতে হবেই। কিন্তু যেসব কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দর বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমরা মনে করি।”

”শুধু সিপির (সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস) বাইরে যেভাবে বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের ইপ্সিত বেশি বেশি মুনাফা লাভের প্রত্যাশা পূরণ করা হচ্ছে, এই দুইটা মিলিয়ে বলা যায় ভোক্তারা ক্রসফায়ারে আছে।”

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি অবশ্য বলছে, গ্যাসের নতুন দর নির্ধারণের সময় তারা ভোক্তাদের দিক যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনায় রেখেছেন।

এসএইচ-২৪/১১/২১ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র : বিবিসি)