সব দেখেও না দেখার ভান করছে সরকার!

গত ১৩ অক্টোবর বুধবার শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন কুমিল্লার একটি মন্দিরে ‘কোরআন অবমাননার’ কথিত অভিযোগের ছবি-ভিডিও ফেসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা হয়। যা থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে।

পরে চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, রংপুরসহ অনেক জেলায় হামলার ঘটনা ঘটে।

এই ঘটনার ২ দিন পর বিজয়া দশমীতে জুমার নামাজের পর ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল করে কয়েকশ মানুষ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। একই সময়ে চট্টগ্রামের পূজা মণ্ডপে হামলা হয়।

ওই দিনেই প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতির মধ্যে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে কয়েকটি পূজামণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িঘরে দফায় দফায় হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন।

এসব হামলার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে গত রোববার রাত ১০টার দিকে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, বটতলা ও হাতীবান্ধা গ্রামে অন্তত ২৫টি বাড়ি-ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘আমরা ২০০৮ সালের আগে যা দেখেছি, এরপর থেকে আজ পর্যন্ত যে চিত্র এর মধ্যে আমরা কোনো পরিবর্তন দেখি না। প্রশাসন আগে যা ছিল, সরকারের বিভিন্ন মহলের অবস্থানও একই রকম আছে। দেখেও না দেখার ভান করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবীরা একটা অবস্থান নিয়েছেন। এটা একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এভাবে কেবল বিবৃতি দেওয়া কিংবা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার মধ্য দিয়ে আমরা শান্তি পাবো না।’

এ ছাড়া যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কিংবা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা-নিপীড়নের পরপর পারস্পরিক দোষারোপের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান রানা দাশগুপ্ত ।

এই আইনজীবী বলেন, ‘আমরা শান্তি পাবো, যদি আমরা দেখি ব্লেম গেম না করে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের নিয়ে একসঙ্গে বসে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কীভাবে ধর্মীয়, জাতিগত ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা শান্তি ও স্বস্তি নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন।’

‘আমরা একটা জাতীয় ঐকমত্যের ঘোষণা চাই। অন্তত যে ঘোষণাটা দেখলে পরে বা শুনলে পরে আমরা আবারও আশা এবং আস্থায় বুক বাঁধতে পারব। আমরা কোনো ব্লেম গেম চাই না।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘এটার ভেতরে দুইটা উপাদান আছে। একটা হলো সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা। আরেকটা হলো শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার রাজনীতি। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়াজড়ি করে আছে।’

সেলিম বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আমরা ব্রিটিশ আমল থেকে পরিচিত। পাকিস্তানি আমলে সেটা আমাদের সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারের ভেতরে নিক্ষেপ করে রেখেছিল। বাংলাদেশে সেই অন্ধকার দূর করে যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই আলো সহসাই নিভে গেছে।’

‘এখানে ২টা উপাদান দেখা যাচ্ছে। একটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি শক্তি। বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে সশস্ত্রভাবে তারা রগ কাটে, হত্যা করে। আরেকটা আমার মতে আরও ভয়ানক। সেটা হলো, সোশ্যাল সাইকোলজি অব কমিউনালিজম। মানুষের ভেতর, সমাজের ভেতর যা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা আরও ভয়াবহ হয়েছে।’

এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করে সিপিবি সভাপতি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বলি আর বিএনপি বলি, কোনো সরকারই জনগণের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে শাসন চালায় না। শাসন চালানোর জন্য তাদের কৃত্রিমভাবে ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করতে হয়। সেই ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে তারা সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্রটাকে ব্যবহার করে। দুই দল পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, কার বেশি ইসলাম পছন্দ। তারা সেটা প্রমাণের জন্য নেমে পড়ে। আর তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের খেলায় কিংবা তাদের রাজনীতির সমীকরণ মেলানোর জন্য সাম্প্রদায়িকতার কার্ড ব্যবহার করে।’

‘তার প্রতিফলনই আমরা কুমিল্লা থেকে শুরু করে সবগুলো ঘটনার ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি।’

এ ছাড়া পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তব্য, ‘পুলিশ ভূমিকা পালন করে না কেন, যতটা করা উচিত? তার একটা কারণ হলো, দক্ষতার অভাব। আরেকটা হচ্ছে হাইকমান্ড থেকে ভিন্ন ধরনের সিগন্যাল থাকে। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যের ভেতরেও সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পড়েছে।’

সব মিলিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করে সেলিম বলেন, ‘আমি এর জন্য সরকারকে অ্যাকিউজ করতে চাই। তার (সরকারের) সাম্প্রদায়িকতা তোষণের পরিণতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। আগুন নিয়ে খেলেছে সরকার। মনে করেছে সবকিছু কন্ট্রোলে রাখতে পারবে।’

এ দিকে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে বাহিনীর সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদার বক্তব্য, ‘এটা তো বেসিক্যালি একটা ফৌজদারি অপরাধ। যা পুলিশের দেখার কথা। তাদের একটা প্রো-অ্যাকটিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকার কথা। ছিলও নিশ্চয়ই। তবে সব সময় তো সব সিচুয়েশন কন্ট্রোল করা যায় না। ইনসিডেন্ট তো হয়ই এ রকম।’

নুরুল হুদার মতে, ‘সেদিক থেকে এটা আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু না। তারা (পুলিশ) তো যথেষ্ট অ্যাকশন নিয়েছে দেখা যায়। হাজীগঞ্জে তো ৪ জন মারা গেছে। পুলিশের অ্যাকশন ছিল বলেই তো এটা হয়েছে। অ্যাকশন না নিলে তো ভ্যান্ডালিজম আরও বেশি হতো।’

‘আর বিভিন্ন মণ্ডপ থাকে। পুলিশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। একটা ঘটনা তো না। মাল্টিপল সেন্টারস। সেই ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে যে সব ল্যাপসগুলোর কথা বলা হচ্ছে তা আমি খুব আনইউস্যুয়াল মনে করি না। কিন্তু প্রিভেন্টিভ মেজারসগুলো জরুরি। এর সল্যুশন অন্য জায়গায়। এসব ঘটনার মধ্যে না।’

তার পরামর্শ হলো, ‘কেউ এটার ডিজাইন করে থাকলে তার ইনভেস্টিগেশন জরুরি দরকার। বোথ দ্য এনকোয়্যারি অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন। যারা জড়িত তাদের মোটিভ জানাটা জরুরি। এটা খুব কঠিন কিছু না।’

তিনি বলেন, ‘এটা সিম্পলি বোঝা যাচ্ছে, হিন্দু কিংবা মুসলিম কেউ কোরআন শরীফ ওখানে রাখবে না। তাহলে এটা ডায়াবোলিজম (শয়তানি)। এ ক্ষেত্রে এর ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখা দরকার।’

এসএইচ-০৩/১৯/২১ (অনলাইন ডেস্ক, দ্য ডেইলি স্টার)