সাম্প্রদায়িক সহিংসতা: গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে৷ এই সময় গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে৷

পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়া যাওয়ার পর ১৩ অক্টোবর সকালে প্রথম কুমিল্লায় হামলা হয়৷ ওই দিন কুমিল্লায় আটটি মণ্ডপ-মন্দিরে হামলা হয়৷ পরে এর জেরে চাঁদপুরে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন৷ অথচ গণমাধ্যমে সেদিনের খবর যথাযথ গুরুত্ব পায়নি৷

দেশের অনলাইন পত্রিকাগুলোতে ১৩ অক্টোবর বিকালের পর থেকে কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে হামলার ঘটনা নিয়ে খবর প্রকাশ পেতে শুরু করে৷ অথচ ততক্ষণে নগরীতে উত্তেজনা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন বিজিবি মোতায়েন করে৷ ‘কুমিল্লায় বিজিবি মোতায়েন, ঘটনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ’ শিরোনামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে খবর প্রকাশ পায়৷ ওই দিন বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়া নিয়ে শহরে উত্তেজনা, মণ্ডপে হামলা’৷

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে বুধবার রাত ৮টার দিকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌর এলাকায় ‘তৌহিদি জনতা’ ব্যানারে মিছিল বের করে সেখান থেকে লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়ায় হামলা হয়৷ সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হন৷ একইদিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কর্ণফুলী উপজেলায় মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে৷ যা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ‘বাঁশখালী-কর্ণফুলীতে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর’৷

এতগুলো মন্দিরে একদিনে হামলা এবং প্রাণহানির ঘটনার পরও তা নিয়ে পরদিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথমসারির বেশিরভাগ দৈনিক পত্রিকাগুলোর মফস্বল সংস্করণে কোনো খবর প্রকাশ পায়নি৷ দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলোর মফস্বল সংস্করণে ১৪ অক্টোবর মণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা নিয়ে কোনো খবর নেই! নগর সংস্করণে প্রথম পাতার মাঝামাঝিতে এক কলাম ছোট্ট করে প্রকাশ করা খবরের শিরোনাম ‘কুমিল্লার ঘটনা খতিয়ে দেখছে সরকার’৷

আজকের পত্রিকা এবং সংবাদ-এর মফস্বল সংস্করণেও ১৪ তারিখে কুমিল্লায় মন্দিরে হামলা বা তার জেরে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষবাষ্প নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ পায়নি৷

সমকালের প্রথম পাতায় নিচের দিকে ছবিসহ এক কলামের খবরের শিরোনাম ‘কুমিল্লায় নিরাপত্তা জোরদার, ঘটনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ’৷

নয়া দিগন্তে প্রথম পাতায় নিচের দিকে ছবিসহ দুই কলামে খবরের শিরোনাম ‘কুমিল্লায় পূজামণ্ডপ ঘিরে উত্তেজনা সংঘর্ষ’’৷

১৪ অক্টোবর সংবাদ মাধ্যমগুলোতে গুরুত্ব না পেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হামলার সত্য-মিথ্যা খবর, ভিডিও ‍বা ছবি ভাইরাল হয়েছে৷ কেউ কেউ ‘পরিকল্পিতভাবে’ ফেসবুকে তা ছড়ি দেওয়ার অভিযোগও করেছেন৷

মূলধার গণমাধ্যমগুলোতে সেভাবে খবর প্রকাশ পাচ্ছে না৷ অথচ ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একের পর এক ভিডিও, ছবি ভাইরাল হচ্ছে৷ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া খবরের উপর নির্ভর করে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ছিল৷ একের পর এক মন্দির-মণ্ডপে হচ্ছিল হামলা৷ পরিস্থিতি সমাল দিতে বুধবার রাত থেকে দেশের ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়৷

প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ১৪ অক্টোবর মন্দিরে হামলার ঘটনা নিয়ে কয়েকটি খবর প্রকাশ পায়৷ দুপুরের দিকে ‘দেশের ২২ জেলায় বিজিবি মোতয়েন’, ‘কুমিল্লায় নিরাপত্তা জোরদার, নতুন গ্রপ্তার নেই’, ‘কুমিল্লায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আটক ৩৫’, ‘সীতাকুণ্ডে বিজিবি মোতায়েন, মন্দিরে নিরাপত্তা’৷

হিন্দুদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার মধ্যে ১৩ থেকে ১৫ অক্টোবর তিনদিনে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, খুলনা, গাজীপুর, বান্দরবন এবং বরিশালের অন্তত ৭০টি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ৷ হামলার সময় হিন্দুদের ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট লুটের ঘটনাও ঘটে৷

১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজধানী ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ, পল্টন ও কাকরাইল এলাকায় এবং নোয়াখালীর চৌমুহনীতে পুলিশের সঙ্গে লোকজনের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়৷ চৌমুহনীতে সংঘর্ষের সময় যতন কুমার সাহা নামে এক ব্যক্তি মারা যান৷ এদিন সারাদেশে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় মোবাইল ফোন গ্রাহকরা থ্রিজি ও ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেনি৷ শুক্রবার ছিল বিজয় দশমী৷ এদিন দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়৷ বিকালের পর থেকে ইন্টারনেট সেবা স্বাভাবিক হতে শুরু করে৷

১৫ অক্টোবর আজকের পত্রিকার প্রথম পাতায় হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা নিয়ে দুইটি খবর প্রকাশ পায়৷ একটির শিরোনাম ‘নেতারা বলছেন রাজনীতি, পুলিশ বলছে নাশকতা’ এবং ‘কুমিল্লার ঘটনায় কেউ ছাড় পাবে না: শেখ হাসিনা’৷

অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও এদিন মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ধরে খবর প্রকাশ করে৷

পরদিন মামলা, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরষ্পরকে দোষারোপ করে দেয়া বক্তব্য নিয়ে খবর প্রকাশ পায়৷ এদিনও মুন্সিগঞ্জ, ফেনী ও নোয়াখালীতে মন্দিরে হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে৷ নোয়াখালীর চৌমুহনীর একটি মন্দিরের পাশের পুকুর থেকে হিন্দু এক ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার হয়৷

কয়েকদিনের মধ্যে গণমাধ্যমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়া এবং ফলোআপ নিউজের অভাবে অতীতে সাম্প্রদায়িক হামলার অনেক ঘটনার মতো এবারের ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যেত হয়তো৷

কিন্তু ১৭ অক্টোবর রাতে এক হিন্দু তরুণ ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে পোস্ট দিয়েছে অভিযোগ তুলে রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া জেলেপল্লির অন্তত ৩০টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়৷

জেলেপল্লিতে আগুন, পুলিশের হামলাকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা, এসব খবরের উৎসও সেই সামাজিক যোগাযোগ ‍মাধ্যম ফেসবুক৷ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে অন্ধকারের মধ্যে গ্রাম থেকে লাল আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়৷ পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘাতের কিছু ভিডিওচিত্রও ছড়িয়ে পড়ে৷

খবর পেতে গণমাধ্যমের উপর নয় বরং এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সুযোগ নিচ্ছে একটি কুচক্রীমহল৷ যার দায় গণমাধ্যমের উপরও বর্তায় বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংবাদিক৷ যিনি দীর্ঘদিন ধরে সংবাদপেশার সঙ্গে যুক্ত৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে প্রচুর ‍অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হত৷ সাংবাদিকরা খবরের পেছনের মূল খবর খুঁজে বের করে নিয়ে আসতেন৷ এখন শুধু বক্তব্যের ভিত্তিতে খবর হয়৷ কে কী বললেন তাই নিয়ে খবর৷ কে কী করছেন সেটা জনগণের সামনে তুলে আনার কোনো চেষ্টা নেই৷ সংবাদমাধ্যমগুলো যেন এক একটি কর্পোরেট হাউজের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে৷’’

কুমিল্লায় মণ্ডপে হামলার ঘটনা শুরু থেকে আরো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক গাজী নাসিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা শুরুতেই হামলা হওয়ার খবর পাচ্ছিলাম৷ কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন থেকে পরিষ্কার করে কিছু জানাচ্ছিল না৷ সেখানে ঠিক কী ঘটেছে সেটা নিশ্চিত হওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল৷ যেহেতু ঘটনার পুরো ছবিটা পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই গণমাধ্যম একটু সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল বলে আমার মনে হয়৷

‘‘তবে আমি এটাও মনে করি, ঠিকঠাক খবর না দিতে পারা কোনো কাজের কথা না৷ খবরটি শুরু থেকেই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা উচিত ছিল৷’’

দুর্গাপূজার মধ্যে একদিনে সহিংসতায় চারজন নিহত হওয়ার পরও গণমাধ্যমে সে খবর শুরুতে না আসার পেছনে কী কোনো চাপ ছিল? নাকি সেল্ফ-সেন্সরশিপ থেকে গণমাধ্যম এটা করেছিল? এর উত্তরে গাজী নাসিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘‘চারজন নিহত হওয়ার খবরের বিষয়ে আমি বলবো, গণমাধ্যম এক্ষেত্রে সেল্ফ-সেন্সরশিপ করেছে৷ এই ধরনের খবরের বেলায় সেটা যেন দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আগে থেকেই এই রীতি চালু আছে৷ এক্ষেত্রে সরকারের চাপ ছিল সেটা বলা যাবে না৷ তবে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে একটি নোটিশ ছিল৷ সঙ্গে সেল্ফ-সেন্সরশিপ মিলিয়ে এই খবরটি প্রচারের আগে গণমাধ্যম কিছুটা সময় নিয়েছে বলে আমার মনে হয়৷ যদিও আমি সবসময় তথ্যের অবাধ প্রবাহে বিশ্বাস করি৷ সেই জায়গা থেকে বলবো, গণমাধ্যম এক্ষেত্রে সঠিক কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে৷’’

এসএইচ-০১/২৩/২১ ( শামীমা নাসরিন, ডয়চে ভেলে)