পুলিশের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিতেও লাগাম টানা যাচ্ছে না

কোভিড-১৯ মহামারীতে নানা সময় নানা পরিস্থিতিতে ‘মানবিক পুলিশের’ স্বাদ পায় দেশের মানুষ। এই মানবিকতা সব মহলে প্রশংসিতও হয়। কিন্তু পুলিশের এই মানবিক ভাবমূর্তি বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে বাহিনীর কিছু সদস্যের ‘অমানবিক’ কর্মকাণ্ডে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের মতো ছোট ছোট বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে খুন, ছিনতাই কিংবা ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধে জড়ালে মাত্রা অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কতিপয় সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি সংকটে ফেলা যাবে না।

পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর পুলিশের বিরুদ্ধে গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে ১০ থেকে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাস্তি হয় দুইভাবে; লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড। প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই লঘুদণ্ড হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিভাগীয় মামলায় ৬৭ হাজার ৩৯ জন পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬২ হাজার ৮৯৯ জনকে লঘুদণ্ড এবং ৩ হাজার ৬২৩ জনকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে চাকরিচ্যুত করা। ওই পাঁচ বছরে ৫১৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর পর ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গুরুদণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায়িছে ৫ হাজার ৩৯৬ জনে; যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি।

শাস্তি হওয়া ৬৭ হাজার ৩৯ জনের মধ্যে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে তদুর্ধ্ব (অতিরিক্ত আইজিপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৪৬, পরিদর্শক ২৬২, কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার ৬৬ হাজার ৭৩১ জন। পরিসংখ্যান বলছে, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরাই শাস্তির মুখে বেশি পড়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখার ডিআইজি হায়দার আলী আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনাতেই আলাদা আলাদা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’

পুলিশ সদর দপ্তর ২০১৯ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, মোট অভিযোগের ৫০ শতাংশ এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরে জমা পড়া অভিযোগ থেকে, অনলাইনে এসেছে ৭ শতাংশ, আইজিপি’স কমপ্লেইন মনিটরিং সেল থেকে এসেছে ২৭ শতাংশ, গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে ৭ শতাংশ এবং বিভিন্ন দপ্তর সংস্থা/দপ্তর থেকে এসেছে বাকি ৯ শতাংশ অভিযোগ। অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- ঘুষগ্রহণ, মাদকসংশ্লিষ্ট অভিযোগ, পারিবারিক সমস্যা, নৈতিক স্খলন, মিথ্যা মামলায় জড়ানো, মামলার তদন্তে পক্ষপাত, দুর্ব্যবহার-আধিপত্য বিস্তার, পুলিশ ভেরিফিকেশন, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ করে চাকরিতে যোগদান, ট্রাফিক পুলিশের অনিয়ম, অবাধ্যতা ইত্যাদি।

সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনির সঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি গোলাম সাকলায়েনের সম্পর্ক, তার বাসায় পরীমনির ১৮ ঘণ্টা কাটানোসহ আরও কিছু ঘটনা পুলিশকে বিব্রত করে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সাকলায়েনকে ডিবি থেকে সরিয়ে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) বদলি করা হয়।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েনের এ ঘটনাকে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তারা এও বলেছেন, ঘটনাটি পুলিশ বাহিনীর জন্য লজ্জার। একটি মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা হিসেবে ভিকটিমকে এভাবে নিজ বাসায় ডাকা এবং একসঙ্গে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে করা যায় না।

এই ঘটনার রেশ না কাটতেই এক ব্যবসায়ীর স্বর্ণ আত্মসাৎ করে গ্রেপ্তার হন ফেনী জেলা ডিবি পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলামসহ ৬ পুলিশ সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরেই মানুষকে জিম্মি করে আর্থিক ফায়দা নিয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ৯ এপ্রিল এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ নেওয়ার অভিযোগে রাজাধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে র‌্যাবের চার সদস্যকে আটক করে হাতিরঝিল থানাপুলিশ। পরে তাদের র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে তিনজন সেনাবাহিনীর ও একজন বিমানবাহিনীর সদস্য ছিলেন। অপহরণ মামলায় আটককৃতরা হলেন-ল্যান্স করপোরাল দুলাল মৃধা, সৈনিক রোকন মিয়া, ল্যান্স করপোরাল মো. রনি ও সৈনিক মো. সাগর। তদন্তের পর এই চার র‌্যাব সদস্যকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়। নিজ নিজ বাহিনীর আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হবে বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে এক নারী ও তার ছেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে রংপুর সিআইডির এএসপিসহ তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- রংপুর সিআইডির এএসপি সারোয়ার কবির, এএসআই হাসিনুর রহমান ও কনস্টেবল আহসানুল হক।

এসব বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘হঠাৎ করে এসব বেড়ে গেছে, তা বলব না। যে অনিয়মগুলো হয়, সেগুলোর কোনো বিচার হয় না। বড় জোর ডিপার্টমেন্টাল কিছু অ্যাকশন হয়। যে কারণে এটি বিকশিত হতে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এখন বেরিয়ে আসছে একের পর এক ঘটনা। এটি খুবই উদ্বেগজনক। গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এটি সহায়ক নয়। যারা অপরাধে জড়ান, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। নইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা যতটুকু আছে, তা-ও হারাবে।’

পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখ। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরতে পুলিশ সদর দপ্তরের বিভিন্ন সেল এখন আগের চেয়ে আরও সক্রিয়। পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটেও এ ধরনের সেল কাজ করছে।

জাতিসংঘ শান্তি মিশনে থাকাকালীন এক নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা হয়েছে। ঘটনাটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে হলেও একজন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরেক নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগটি নিয়েও দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনাও পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

স্বর্ণ, নগদ অর্থ, মুঠোফোন ও মালামাল লুট করার অভিযোগে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গত ৯ আগস্ট মামলা হয়েছে। গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় ই-অরেঞ্জের প্রতারণার শিকার মো. তাহেরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক একটি মামলা করেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ই-অরেঞ্জের অন্যতম ‘হোতা’ ছিলেন বনানী থানার ওসি (বরখাস্তকৃত) সোহেল রানা। পালিয়ে ভারতে গেলে বিএসএফের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।

রাজধানীর মোহাম্মাদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক এসএম সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িসহ সাড়ে তিন কাঠা জমি দখল করে নেন ট্রাফিক পরিদর্শক ওয়াবদুল হক। সেখানে সিদ্দিকুর রহমানের মায়ের নামে বানানো দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র ভেঙে পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুল হক নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ১০তলা ভবন। ভবনের নাম ‘আন্দালুসিয়া টাওয়ার’। এর পর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশের তদন্তেও উঠে আসে ওবায়দুল হকের দখলবাণিজ্য। তবে এখনো তার কোনো শাস্তি হয়নি। এ বিষয়ে আদালতে মামলা করেছেন সিদ্দিকুর রহমান।

স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেছিলেন রাজশাহী নগরীর এক গৃহবধূ। কিন্তু বিচারপ্রার্থী গৃহবধূকে উল্টো যৌন নির্যাতন করেছেন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। কিছুদিন আগে নগরীর বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এএসআই মো. শামীমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বরিশালের উজিরপুর থানায় গত মাসে রিমান্ডে থাকা এক নারী আসামিকে যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতন করেন ওসি জিয়াউল হাসান ও মাইনুল। ওই দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।

পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. বেনজীর আহমেদ একাধিক সভায় বাহিনীর সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকা- থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলেও হুশিয়ারি দেন তিনি। কিন্তু তার এই নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে কতটুকু প্রভাব ফেলছে, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনসহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো এসব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’

এসএইচ-০৩/২৬/২১ (অনলাইন ডেস্ক)