সীমান্ত হত্যা বন্ধের ওয়াদা ভারত মানে না!

সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি কি শুধুই মুখের কথা, না ভারতের আন্তরিক ইচ্ছা আছে? তারা তাদের আন্তরিকতার কী প্রমাণ এখন পর্যন্ত রেখেছে?

লালমনিরহাট সীমান্তে বৃহস্পতিবার ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে দুই বাংলাদেশি নাগারিক নিহত হওয়ার পর সীমান্ত হত্যা আবার আলোচনায় এসেছে। এমন কী ভারতীয়রাও এটা নিয়ে কথা বলছেন।

চলতি নভেম্বর মাসেই বিএসএফ-এর হাতে চারজন বাংলাদেশি নিহত হন। ২ নভেম্বর সিলেট সীমান্তে দুইজন এবং ১১ নভেম্বর লালমনিরহাট সীমানে দুইজন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন বিএসএফ-এর হাতে।

এই ঘটনার পর রোববার ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন,”সীমান্ত হত্যা ভারতের জন্য লজ্জার। দুই দেশের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সীমান্তে কোনো ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। গুলি করা হবে না। কিন্তু এটা হচ্ছে। তাই এটা ওদের জন্য লজ্জার। আর আমাদের জন্য দুঃখের, আমরা জীবন হারাচ্ছি।”

এদিকে সোমবার দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, নিশ্চিতভাবে সীমান্ত হত্যা উভয় দেশের জন্য দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি তাদের ওপর হামলার কোনো শঙ্কা না থাকে, তবে যেন সীমান্তে কোনো অবস্থাতেই গুলি না চালায়। আমরা কোনো দেশেই সীমান্ত হত্যা চাই না। সীমান্ত হত্যা একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা।

কিন্তু এই উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার বাস্তব কোনো প্রতিফলন নেই। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই নয় মাসে সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে মোট ১১ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ১০ জনকে। একজনকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে। এই সময় গুলিতে আহত হয়েছেন ছয়জন। আর অপহরণ করা হয়েছে তিনজনকে।

২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে। আহত হয়েছেন ২৬ জন।

২০১৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে। আহত হয়েছেন ৪৮ জন।

২০১৮ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিলো। তারপরও ওই বছর বিএসএফ সীমান্তে মোট ১৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করে। এরমধ্যে গুলি করে আটজনকে হত্যা করা হয়। অপহরণ করা হয় ১৩ জনকে এবং আহত হন ১৫ জন।

আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন,”ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বন্ধ হচ্ছেনা। তারা সীমান্ত হত্যা শূণ্যে নামিয়ে আনার কথা বলার পরই আবার সীমান্ত হত্যা শুরু হয়।

তাদের আচরণ দেখে মনে হয় ভারত নিজেদের প্রভু মনে করে। আর আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারব না।”

তিনি বলেন,”পাকিস্তানের সাথেও ভারতের সীমান্ত আছে। সীমান্ত সমস্যা আছে। কিন্তু সেখানে কিন্তু ভারত এভাবে গুলি চালায় না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শুধু গরু চোরাচালান হয় না, ভারত থেকে ফেনসিডিল, মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রও আসে। সেটা বিএসএফ দেখে না। আর গরু তো শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসে। সেখানে কেন আটকানো হয় না?”

তার কথা, ফেলানি হত্যার মত সুনির্দিষ্ট ঘটনায় মামলা করেও বিচার পাওয়া যায় না। ফলে বিএসএফ এর থামার কোনো কারণ নেই।

ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ( মাসুম) মনে করে বিএএসফ সদস্যরা যখন ঠিকমত ভাগ না পায় তখন গুলি করে। সংগঠনটির প্রধান কিরিটী রায় দাবী করেন,”একদানা চিনিও বিএসএফ-এর নজর এড়িয়ে যেতে পারে না বাংলাদেশে। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। এর প্রমাণ বার বার পাওয়া গেছে। চোরাচালান ঠেকানোর নামে তখনই তারা গুলি করে যখন তাদের ভাগ বাটোয়ারায় কম পড়ে।”

তিনি বলেন, “বিএসএফ শুধু বাংলাদেশিদের নয় ভারতের বাঙালিদেরও হত্যা করছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএফ-এর হাতে অনেক ক্ষমতা দিতে চায়। তারা বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে জানালেও বাস্তবে সেটা তারা মনে করে না। আর বাংলাদেশ সরকার চুপ করে আছে।”

বাংলাদেশ ও ভারতের এই দুই মানবাধিকার কর্মী মনে করেন,” ভারতের মুখের কথা আসলে বাস্তবে দেখা যায় না। তাই বাংলাদেশের উচিত সীমান্ত হত্যা বন্ধে আরো শক্ত অবস্থানে যাওয়া।”

এসএইচ-০২/১৬/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)