স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিয়ে বিব্রত আওয়ামী লীগ

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে বিব্রত আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রতীকের কারণেই এমন হানাহানি এবং বিদ্রোহ এমনটাই মনে করছে ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতৃত্ব।

ফলে এখন দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়া চিন্তা করছে তারা। আওয়ামী লীগের যেকোনো সিদ্ধান্তে আপত্তি থাকলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দিলে বিএনপির সমর্থন থাকবে বলে জানা গেছে ।

গত ২৫ অক্টোবরের নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ড সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম তার নির্বাচনি আসন গোপালগঞ্জ-২ এ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উন্মুক্ত রাখার প্রস্তাব করেন।

তিনি বলেন, একজনকে মনোনয়ন দিলে অন্যজন কষ্ট পান। তাতে সংসদ সদস্য হিসেবে আমার বিব্রত হতে হয়। উন্মুক্ত রাখা হলে এই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না।

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের এরই মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারাও।

এর বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হচ্ছ দলটি। এই ইস্যুটি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করেন। ওই সভায় বেশ কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতীক না রাখতে পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এখনও আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি। আগামী শুক্রবার আমাদের আরেকটি সভা আছে, সেখানেও এটা নিয়ে আলোচনা হবে। তবে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রস্তাব দেয় আমরা আলোচনা করতে পারি। নির্বাচন কমিশন এই আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে।’’

নির্বাচন কমিশনের সচিব হুমায়ুন কবীর খন্দকার বলেন, ‘‘এটা আমাদের এখতিয়ার না। আমাদের কাজ নির্বাচন আয়োজন করা। দলীয় প্রতীক থাকবে কি-না সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাহলে সেটা সংসদে বিল পাশ করাতে হবে। যেটাতে আমাদের এখতিয়ার নেই, সেটা নিয়ে আমরা আপাতত ভাবছি না।’’

বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ  বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে কী আলোচনা করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে? তাহলে আমরা কেন প্রস্তাব দেব? আমরা তো এবারের ইউপি নির্বাচনে কোন প্রার্থী দেইনি। তবে আমাদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা না করলেই হয়। তাহলেও পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। কারণ দলীয় প্রতীক দেওয়ার ফলে প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে নির্বাচনে জিতিয়ে দিতে নানা তৎপরতা শুরু করে।’’

এখন পর্যন্ত দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমরা হানাহানি চাই না।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, শুধু দলীয় প্রতীক বাদ দিলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তিনি বলেন, ‘‘পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাতেই আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এখন তো নির্বাচন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। এই নির্বাচনে কারা অংশ নিচ্ছে? যার এলাকায় প্রভাব আছে। সংঘাতে কারা জড়াচ্ছে, যারা ওই চেয়ারে বসতে চায়। কারণ যেই ওই চেয়ারে বসবে সেই অর্থসম্পদের মালিক হবে। ফলে শুধু প্রতীকে কিছু যায় আসে না।’’

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দিতে হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে সংসদে বিল তুলতে হবে। এ বিষয়ে কী কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এখনও এমন কোন প্রস্তাবনা আসেনি। তবে সংসদে বিল না তুলেও এটার বাস্তবায়ন করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রার্থী ঘোষণা না করলে নির্বাচন কমিশন কোন প্রর্থীকেই দলীয় প্রতীক দিতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেই এটা করা সম্ভব।’’

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘এই সঙ্কট এখন শুধু প্রতীকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন কমিশন পুরো প্রক্রিয়াটি নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে এখন টাকা উপার্জনের জন্য এই পদগুলো দরকার। যে কারণে হানাহানি অনেক বেশি হচ্ছে।’’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানও মনে করেন, শুধু দলীয় প্রতীক বাদ দিলে কোন লাভ হবে না। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই ঢেলে সাজাতে হবে।’’

২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন উন্মুক্তভাবে হওয়ার বিধান বাতিল করে বর্তমান সরকার দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৬ সালে পৌরসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরু করে মতাসীনরা। এরপর পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত দলীয় প্রতীক দিয়ে হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন পরিবর্তন করে নতুন নিয়মে শুরু হয় নির্বাচন। কিন্তু এ নিয়ে প্রথম থেকেই খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

এসএইচ-০২/১৮/২১ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)