নেতাকর্মীদের বিষয়ে আ’লীগ কঠোর হচ্ছে!

গত দুই মাসে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মীদের বহিস্কার করা হয়েছে৷ যদিও এটি চলমান প্রক্রিয়া বলে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা৷

‘‘বহিস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া৷ কেউ শৃঙ্খলাভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ গঠনতন্ত্র অনুসরণ করেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়,’’ বলছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ বি এম মোজাম্মেল হক।

গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বহিস্কারাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গত দুইদিন ধরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়৷ তবে গত সেপ্টেম্বর থেকেই বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে বহিস্কার করেছে দলটি৷ সবচেয়ে বড় আকারে বহিস্কার চলছে সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে৷ দলের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে জেলা পর্যায় থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বাদ দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হচ্ছে৷ তবে এই সংখ্যাটি সর্বমোট কত তার কোন পরিসংখ্যান নেই কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে৷

আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, ‘‘প্রতিনিয়তই শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য বহিস্কার করা হচ্ছে৷ শুক্রবারের বৈঠকে মেয়র জাহাঙ্গীর ছাড়াও কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিস্কার করা হয়েছে৷ এছাড়া নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হলেও বহিস্কার করা হয়৷ প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এখন বিদ্রোহী প্রার্থীদের যারা মদদ দেবে তারাও বহিস্কার হবে৷’’

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে ‘দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে’ বহিস্কার করা হয়েছে৷ শুক্রবার আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন৷

গত সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়৷ এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন৷

এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা৷ তারা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান৷ এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ এ নিয়ে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে৷

গত ৩ অক্টোবর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়৷ ১৮ অক্টোবরের মধ্যে জাহাঙ্গীরকে এর জবাব দিতে বলা হয়৷ তিনি জবাবও দেন৷

বহিস্কারের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘‘আমি কী অপরাধ করেছি, সেটাই তো জানি না৷ কোন নেতা আমার সঙ্গে কথা বলেননি৷ আমি ষড়যন্ত্রের শিকার৷ দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমি রিভিউ করার জন্য অনুরোধ করব৷ আমার বিশ্বাস আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে তিনি বিবেচনা করবেন৷”

যদিও এর আগে জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ করা হয়েছিল৷ কিন্তু তার জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে ‘হাইকমান্ড’ দল থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়৷ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘‘নেতাদের দ্বন্দ্বে আমি জবাই হয়েছি৷ আমার প্রতি অন্যায় হয়েছে৷ আইনগতভাবে আমাকে মেয়র পদ থেকে সরানোর সুযোগ নেই৷ এখন জোর করে যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আমি আর কী করতে পারি৷’’

সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সিটি কর্পোরেশন আইনের ১৫ ধারায় বলা আছে, কী করলে মেয়র পদ থাকবে না৷ তার মধ্যে দলের পদের কথা উল্লেখ নেই৷ শুধুমাত্র ফৌজদারি অপরাধ করলেই তার মেয়র পদ যেতে পারে৷ তাও আবার পুলিশ যদি চার্জশিট দেয় তাহলে তিনি সাময়িক বহিস্কার হবেন৷ আর রায়ে শাস্তি হলে তার মেয়রপদ চলে যাবে৷

তিনি বলেন, ‘‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে যেমন সংসদ সদস্যদের কথা বলা হয়েছে৷ সেখানে কিন্তু দল থেকে পদত্যাগ করলে সংসদ সদস্যপদ চলে যাবে৷ আবার সংসদে দলের দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলেও সংসদ সদস্যপদ চলে যাবে৷ কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে এমন কিছু উল্লেখ নেই৷ ফলে এই মুহূর্তে ফৌজদারি মামলা ছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মেয়র পদ যাওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না৷’’

‘দু’ একজন বহিস্কারে কিছু যায় আসে না’

এ বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, আওয়ামী লীগ একটা বিশাল রাজনৈতিক দল৷ প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় অন্তত তিনজন যোগ্য প্রার্থী আছেন৷ উপজেলা পর্যায়ে সেটা আরও বেশি৷ ফলে কেউ শৃঙ্খলা ভাঙলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘আর জাহাঙ্গীর তো ভয়াবহ অপরাধ করেছেন৷ তিনি জামায়াতের সুরে কথা বলেছেন৷ আসলে যে পদের জন্য তিনি যোগ্য নন তাকে সেই পদে বসালে এমনই হয়৷ সে আসলে তার নিজের যোগ্যতার বাইরে অনেক বেশি পেয়ে গেছে৷ প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলে দিয়েছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ শৃঙ্খলা ভাঙলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে৷’’

সর্বশেষ ২০১৪ সালে বহিস্কার হয়েছেন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী৷ নিউ ইয়র্কে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করেন তিনি৷ যা নিয়ে দেশেই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়৷ তখন তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন৷

তার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তাকে দলের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোর্টিশ দেওয়া হয়৷ উত্তর দেওয়ার পর তাতে সন্তুষ্ট না হওয়ায় দলের সাধারণ সদস্য পদ থেকেও তাকে বহিস্কার করা হয়৷ এর ফলে তার মন্ত্রীত্ব ও সংসদ সদস্য পদ চলে যায়৷ সরকারের ওই মেয়াদেই টাঙ্গাইলে তার আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷

গত সেপ্টেম্বরে একজন নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় রাজধানীর সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস৷

গত জুলাই মাসে ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্যপদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে৷ জয়যাত্রা টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য ছিলেন৷ বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি৷ যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে৷ এই ঘটনায় পদ হারানোর পাশাপাশি জেলেও যেতে হয়েছে তাকে৷ এছাড়া দলীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীহওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি বহিস্কার হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি থেকে৷ তবে এই বহিস্কারের সংখ্যাটি কত তা জানা যায়নি৷

এসএইচ-০৫/২১/২১ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)