খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিতর্কে দু দল

উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নিতে চাইছে তার দল বিএনপি; এ দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনও করছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এখনো মনে করছেন, আইনে সে সুযোগ নেই। তাই বিএনপি চেয়ারপারসনের পরিবারের বিদেশ পাঠানোর আবেদন নাকচও করেছে সরকার। সম্প্রতি তার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিতে বেশ আলোচনা চলছে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে-বিতর্কে মেতে উঠেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক দলের নেতারা।

বিএনপির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে খালেদা জিয়া জটিল রোগে আক্রান্ত। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার, যা বাংলাদেশে নেই। তবে ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বিএনপি অজুহাত খুঁজছে। তারা চিকিৎসা নয়, রাজনীতির মাঠ জটিল করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, জেলে থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে। এর ফলে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।

পাল্টা জবাবে শুক্রবার বিকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত দলের সম্পাদকম-লীর সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হলে তা বিএনপি নেতারা করেছেন। কারণ বেগম জিয়ার পাশে যারা থাকেন তারা বিএনপি নেতা। তার পছন্দের চিকিৎসকরা চিকিৎসা করছেন। সেবা যিনি করেন তিনি বেগম জিয়ার গৃহপরিচারিকা। সুতরাং বাইরের লোককে দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই।

পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের চেয়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসছে। প্রতিদিনই তাকে নিয়ে মৃত্যুগুজব ছড়াচ্ছে। এ গুজবে রাজনীতিতে উত্তেজনাও তৈরি হচ্ছে। বিএনপির বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও তার উন্নত চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছে।

তা হলে কি খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি রাজনৈতিক বাহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। দুই দল কি পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জড়িয়ে পড়ছেন। নাকি তর্ক-বিতর্কের মধ্যে পর্দার আড়ালে বিদেশ পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এমন নানা আলোচনার মধ্যে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি এখন ঝড় তুলছে জাতীয় সংসদ, এমনকি টেলিভিশনের পর্দায়ও।

অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের দলের নেত্রীর চিকিৎসাটাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ইস্যুতে তৃণমূল পর্যায়ের কঠোর আন্দোলনের চাপ থাকলেও শীর্ষ নেতৃত্ব সেদিকে হাঁটছে না। কারণ তারা যে কোনো পন্থায় সমঝোতার মাধ্যমে তাকে বিদেশ পাঠাতে চায়। এ জন্য তারা হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছে না।

সরকারের মনোভাবে দেশে অনেকেই মনে করছেন, এখনো খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তাই এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর-ই ভরসা রাখতে চাইছেন সরকার-সংশ্লিষ্টরা।

খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে নেওয়া আট দিনের কর্মসূচি শেষ হবে ৩ ডিসেম্বর। এরপর কি রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে- এমন প্রশ্নও উঠছে। সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে গভীরভাবে নজর রেখেছে। আন্দোলন নামলে প্রতিহত করার ঘোষণাও আসে।

সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার চিকিৎসার প্রসঙ্গ টেনে আরও বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ দিয়ে বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিচ্ছে, তা ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। এমনটা হলে তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে দলের নেতাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

২১ ও ২৪ নভেম্বর সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। এ কারণে তাকে ফের জেলে পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি।

এ ছাড়া সরকারদলীয় যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব-উল আলম হানিফ একটি তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। ২৬ নভেম্বর সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ) আয়োজিত এক আলোচনাসভায় তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করলে তিনি বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পাবেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি করতে চায় বিএনপি। তাদের অপরাজনীতি বরদাশত করা হবে না। আদালত আইন অনুযায়ী চলে, কারও কথায় চলে না। তার জন্য আলাদা আইন করার সুযোগ নেই। আইন সবার জন্য সমান।

গত কয়েক দিনে গণস্বাস্থ্যের ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে যান। তারা বেরিয়ে এসে বলেছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই দুর্বল। তিনি গত শুক্রবার ভাসানীর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নিজের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেশেই সম্ভব, নাকি বিদেশে নিতে হবে। যদি নিতেই হয় তা হলে আইনিভাবে কোনো পথ খোলা আছে? বিএনপি বলছে, বাধা সরকার। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, তাকে বিদেশে নিতে আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে এ দেশের সবচেয়ে সংগ্রামী নেতা আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জনগণের চোখের ভাষা তিনি বুঝতে পারেন। তিনিই কিন্তু নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করেছিলেন। খালেদা জিয়ার বয়স ৭৫ বছরের বেশি। তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে এক-এগারোর সময়ে যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, সেই চক্রান্তের অংশ হিসেবে একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে দুই বছরের বেশি সময় আটক রাখা হয়েছিল। স্যাঁতসেঁতে কারাগারের কক্ষে ইঁদুর, চিকা ঘোরাঘুরি করত। এরপর তাকে রাজধানীর পিজি (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, যেখানে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এই যে তার ভেতরে যে রোগের সূত্রপাত হয়েছিল। জনমনে প্রশ্ন, সেদিন কি দেশনেত্রীকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছিল? আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই।

শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খারাপ এবং দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই সরকার এত নির্দয়, তারা রাজনৈতিক হিংসার বশবর্তী হয়ে দেশনেত্রীকে শেষ করে দেওয়ার জন্য বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের বলব, আইনের কথা বলে লাভ নেই। আইনজীবীরা বলছেন কোনো বাধা নেই। বাধা হচ্ছে সরকার।

একই দিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আলোচনাসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘দেশের শতকরা ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ মানুষ বিদেশে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা হোক তা চায়। শুধু একজন চান না। ফাঁসির আসামিকেও ফাঁসি দেওয়ার আগ মুহূর্তে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। এটা সরকারের দায়িত্ব। ফাঁসি দেওয়ার আগ মুহূর্তে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। সে জন্যই বলছি, বিচার তখনই চাওয়া যায়, যখন ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুটো এক হয়ে গেছে। এখন শেখ হাসিনা এমন অবস্থায় গেছেন তার কথাই শেষ কথা, তার কথাই আইন, তার কথায় সংবিধান। হয়তো দুদিন পর তার কথাই হবে ধর্ম। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দাবি করে লাভ হবে না।’

আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ক্ষমা কেন এবং কার কাছে চাইবে? চূড়ান্ত রায়ের আগে এ প্রসঙ্গ তোলাই ষড়যন্ত্র।

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক, তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসা করতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি তার প্রার্থিত জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারবেন না; কত নিষ্ঠুর, অমানবিক সরকার। তারা আইনের দোহাই দেয়, কিন্তু তাদের নিজেদেরই তো আইনি ভিত্তি নেই। বর্তমান সরকার চায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করুক। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও আ স ম রব, আবদুল জলিলকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের উদাহরণ থাকার পরও খালেদা জিয়াকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

এসএইচ-০৬/২৮/২১ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র : আমাদের সময়)