হিজড়ারা নিগ্রহের শিকার নিজের পরিবার থেকেই

“আমার পরিবার মনে করতো আমাকে জ্বীন-ভূতে ধরেছে এই কারণে আমি মেয়েদের মত আচরণ করছি। বিভিন্ন জায়গায় কবিরাজি চিকিৎসা করিয়েছে, শারীরিক নির্যাতন করেছে”।

কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার কাছে ধামরাইয়ের শাম্মী। তিনি এখন একজন রুপান্তরিত নারী।

জন্মগতভাবে তার লিঙ্গ পরিচয় পুরুষের হলেও বয়ঃসন্ধিকালে তিনি বুঝতে পারেন তিনি তার পুরুষ সহপাঠী বা খেলার সাথিদের থেকে আলাদা।

শাম্মী বলছেন তিনি ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মত সাজগোজ করা, ঘর গৃহস্থালির কাজ করা, মেয়েদের সঙ্গ- তার বেশি প্রিয় ছিল।

ফলস্বরুপ বাবা -মায়ের বকা, মারপিট এমনকি তাবিজ-কবজ দিয়ে তার চিকিৎসাও করা হয়েছে। তার পরিবারের কাছে শাম্মী ছিলেন অসুস্থ।

“আমি যাতে বাড়ি থেকে বের না হই, কারো সাথে কথা না বলি সেই ব্যবস্থা তারা করেছিল। কারণ আমি মানুষের সঙ্গে কথা বললেই তারা বলছে আমি হিজড়া। প্রতিনিয়ত আমার বাবা-মা,ভাই-বোন আমার দোষ ধরা শুরু করলো”।

“আমি নিজেও জানি না ঐসময় যে আমি কে, আমি কেন, এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিৎ, আমি কোথায় যাবো, কার কাছে যাবে, আমার কি এই পৃথিবীতে কেউ নেই, আমি কি দুনিয়াতে একাই এইরকম, আমার মত কি আর কেউ নেই এসব প্রশ্ন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। আমি একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,” বলেন শাম্মী।

শাম্মী বলছেন তার বয়স তখন ১৩/১৪ বছর। লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য সপ্তম শ্রেণীতেই শেষ হয় তার পড়াশোনা।

এই সময়ে তার পরিচয় হয় তারই মত তৃতীয়-লিঙ্গের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি তখন হিজড়াদের ডেরায় শাম্মীকে নিয়ে যান। শাম্মী বলছেন যখন তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান তখন তার পরিবার হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়।

এখনো তার পরিবার তাকে মেনে নেননি। রাজবাড়ীর তানিশা ইয়াসমিন চৈতি এখন একজন রূপান্তরিত নারী। জন্মগতভাবে পুরুষ হিসেবে জন্ম নেন তিনি ।

তানিশা ইয়াসমিন চৈতি বলেন, “আমি যখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি তখন আমি মাকে বলে দেই যে মা আমি তোমার পুত্র সন্তান না। আমি মেয়ে হতে চাই। আমার মা সাত দিন সাত রাত শুধু কেঁদেছে। এরপর আমার পরিবার-আত্মীয় স্বজন সবাই বলা শুরু করলো আমি ঢং করে হিজড়া সাজছি”।

“এটা আমাকে অনেক মানসিক পীড়া দেয়। আজও দেয়। একটা মানুষ কি ইচ্ছা করে এমন হতে পারে? আমার পরিবার আমাকে ডাক্তারের কাছ নিয়ে যায়। ডাক্তারদের দেয়া ওষুধ আমাকে পনের দিন খাওয়ায়। এক পর্যায়ে এত মানসিক -শারীরিক টর্চার (অত্যাচার) বেড়ে যায় যে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই”।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যারা সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত তারা সর্বপ্রথমে নিগৃহীত হন তাদের নিজ পরিবারে।

নিজের লিঙ্গ পরিচয় তাদের কে বোঝানোর জন্য রীতিমত যুদ্ধ করতে হয় পরিবারের সঙ্গে।

পরিবারের সদস্যরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন না যে, তাদের যে সন্তান পুরুষ বা নারীর লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে জন্ম নিয়েছে সে একটা বয়সের পর বিপরীত লিঙ্গের একজনের মত আচরণ করবে।

পরিবারের সদস্যরা কেন মেনে নেয় না? এই উত্তর জানতে আমি কথা বলেছিলাম এমন একজনের সঙ্গে যার ছেলে সন্তান এখন রূপান্তরিত নারী হিসেবে পরিচিত।

তিনি তার পরিচয় গোপন করে বলেছেন “আমার যে ছেলে ছিল সে তো এখন হিজড়া হয়ে গেছে। আমি তাকে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, আলাদা ঘর করে দিয়েছি কিন্তু সে থাকেনি। আমার আরো সন্তান আছে, পরিবারের আরো মানুষ আছে। সবার কথা চিন্তা করে আমি তাকে মানতে পারিনি”।

“আমি বলেছি যদি ভালো হয়ে যাও কোনদিন অর্থাৎ পুরুষ হয়ে যাও তাহলে ফিরে আসবে। আশে পাশের লোকজনকে বলেছি সে বিদেশে থাকে”।

তিনি এটাও বলেছেন তিনি মনে করেন তার একটা সন্তান মারা গেছে।

এই ব্যক্তি জানেন তার রূপান্তরিত কন্যা কোথায় আছেন, কী করছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে তিনি মেনে নিতে চান না।

পরিবারের সদস্যদের না মানার পেছনে সমাজের একটা চাপ তাদের উপর তৈরি হয়।

সেই চাপকে অনেকেই উপেক্ষা করতে পারেন না।

নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলছিলেন যখন তার ভাই মেয়েদের মত আচরণ করা শুরু করে তখন তাদের পরিবারকে গ্রামের মধ্যে একঘরে করে দেয়ার উপক্রম হয়েছিল।

ইসলাম বলেন, “আমাকে, আমার বাবাকে গ্রামের লোকজন বলতো তোমার ছেলে তো হিজড়া, সে তো নোংরা, কেন তাকে বাড়িতে রাখো? স্কুল থেকে শিক্ষকরা আমার বাবাকে বলতো আমার ভাইয়ের জন্য অন্যদের পড়াশোনা হবে না, তারা খারাপ হয়ে যাবে”।

“আমার স্ত্রীর কলিগরা তাকে কটু কথা শোনাতো। তবে আমার মা সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে। আমাদের দেখে গ্রামের মানুষ নাক সিঁটকাতো। ১৭/১৮ বছর বয়সে যখন আমার ভাই বাড়ি থেকে চলে যায় আমরা কেউ তাকে ঠেকায়নি। আজ পর্যন্ত সে গ্রামে ঢুকতে পারে না। আমার মা যখন মারা যায় তখন সে চুল কেটে ছেলের পোষাক পরে মাকে একটুক্ষণের জন্য দেখেছে। আমাদের কিছুই করার ছিল না”, বলেন তিনি।

তৃতীয় লিঙ্গ বলতে বাংলাদেশে সাধারণত যেসব পুরুষ নিজেদের নারী মনে করে বা রূপান্তরিত নারীদের বোঝানো হয়।

আবার এমন অনেক পুরুষ রয়েছে যারা নিজেদেরকে নারী মনে করে।

এক লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে জন্ম নিয়ে আরেক পরিচয়ে রূপান্তরের যে বাসনা সেটা কি মানসিক না শারীরিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন যিনি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি বলেন, এটা মানসিক এবং শারীরিক উভয় কারণে হতে পারে।

তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা কমন ফিচার সেটা হচ্ছে তারা বায়োলজিক্যালি পুরুষ কিন্তু তারা নিজেদেরকে নারী মনে করেন। সুতরাং একজন নারীকে তিনি যেভাবে দেখেন সমাজে ,তিনি নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করেন। তাদের মন-মানসিকতায় তারা একেবারেই একজন নারী। পুরুষদের ক্ষেত্রেরেও একই রকম ব্যাপারটা”।

“এটা ছাড়াও আরো জেন্ডার আইডেনটিটির মানুষ আছে যারা নিজেদেরকে পুরুষ বা স্ত্রী কোনটাই মনে করেন না। এরকমও ব্যক্তি আছেন যাদের কে আমরা ইন্টার-সেক্স বলছি। যাদের ক্ষেত্রে বায়োলজিক্যালি যৌনাঙ্গের ক্ষেত্রে অ্যানোমালি দেখা দেয় যার কারণে তারা তাদের যে বায়োলজিক্যাল আইডেনটিটি , তাদের যে ফিজিক্যাল যে প্রকাশভঙ্গী সেখানে নারী এবং পুরুষের যৌনাঙ্গের একটা মিশ্রণ থাকে”, বলেন তিনি।

১৩/১৪ বছর বয়সে যখন একটা শিশু বাড়ী থেকে বের হয়ে একেবারে অচেনা একটা পরিবেশে যায় তখন তাকে নানা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়।

তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে কাজ করে ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’র সভাপতি জয়া শিকদার বলেন প্রথমেই ঐ শিশুটি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

তিনি বলেন, “এমন একটা ছেলে যার আচরণ মেয়েসুলভ, তার অভিভাবক নেই -সে প্রথম ধাপেই সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের (যৌন নিপীড়ন) শিকার হয়। একটা বড় সময় তাকে এই নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এরপর সে কাজের খোঁজ করতে থাকে। এভাবেই হিজড়া কমিউনিটির সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানে তাকে প্রমাণ করতে হয় যে সে হিজড়া”।

“এরপর গুরু মা তার ডেরায় আশ্রয় দেয়। সেখানেও কিন্তু জীবন সহজ না। সেখানে অনেক নিয়ম-কানুন মেনে তাকে চলতে হয়। কিন্তু এই ছেলে অথবা মেয়েকে যদি প্রথমেই তার পরিবার মেনে নিত তাহলে তাকে বাকী জীবন এত বিপর্যয়ের মধ্যে কাটাতে হত না”।

বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কারা সেটা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি।

সাধারণত কোন ছেলে যখন মেয়েদের আচরণ বা মেয়েতে রূপান্তরিত হয় তাকে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কিন্তু যারা তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা বলছেন জন্মগতভাবে পুরুষ লিঙ্গ বা নারী লিঙ্গ অথবা এই দুইটার কোনটাই নাও হতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন সরকারের কাছ থেকে ২০১৮ সালে একটা গেজেট নোটিফিকেশন এসেছিল যেখানে তাদের ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে পরিচয় করার জন্য বলা হয়েছিল।

নানা দাপ্তরিক কাজে নারী, পুরুষের সঙ্গে কখনো অন্যান্য, কখনো হিজড়া লিঙ্গ ব্যবহার করা হয়।

তবে পরিষ্কার করে কোথাও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে সেটা বাংলাদেশে বলা নেই-বলছিলেন তাসলিমা ইয়াসমিন।

“এমন না যে আইন করে তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয়েছে। এক লাইনে ছোট করে গেজেট নোটিফিকেশনে বলা হয়েছে তাদের ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে পরিচয় করাতে। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। এই বিষয়টা আরো বিভ্রান্তি তৈরি করছে”।

“হিজড়া যারা আছেন তারা একটা কালচারাল কমিউনিটি (সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়)। সকল ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি হিজড়া বলে পরিচয় দেন না বা তারা এই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। হিজড়া কোন জেন্ডার আইডেনটিটি নয়। কাজেই তৃতীয় লিঙ্গ বলেন আর জেন্ডার ডাইভার্স কমিউনিটি আমরা যাদের বলি- তাদের পরিচয়টা কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, ফলে পলিসি লেভেলে তারা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে যাচ্ছে”।

তৃতীয় লিঙ্গ, হিজড়া লিঙ্গ বা হিজড়া যেটাই তাদের পরিচয় হোক না কেন তাদের আচার-আচরণ, নারী ও পুরুষের মত সমাজের প্রচলিত আচরণের বাইরে থাকে।

এদের অধিকার নিয়ে নানা সংগঠন আন্দোলন করে, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছে বিভ্রান্তি।

কিন্তু সবার আগে তাদেরকে যদি পরিবার থেকে পূর্ণ সমর্থন দেয়া হয় তাহলে তাদের জীবনে চলার পথ হবে আরো সহজ, মসৃণ।

এসএইচ-০২/০৪/২১ (ফারহানা পারভীন, বিবিসি)