সাধারণ ছাত্রদের দমাতেই সক্রিয় ছিল ছাত্র সংগঠন!

দেশে গত একযুগে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে যে কয়টি বড় আন্দোলন হয়েছে তার সাথে দেশের বড় কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন এবং নেতারা যুক্ত ছিলেন না৷ বরং সাধারণ ছাত্রদের দমাতেই সক্রিয় ছিল কোনো কোনো ছাত্র সংগঠন৷

গত এক দশকে বাংলাদেশে চারটি বড় ছাত্র আন্দোলন হয়েছে৷ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন এবং চলমান অর্ধেক ভাড়া ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন৷ এর কোনোটিতেই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ নেই ৷ সাধারণ ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণেই এইসব আন্দোলন হয়েছে৷ এর বাইরে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কিছু আন্দোলন হয়েছে৷ যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন৷ তা-ও সাধারণ ছাত্রদেরই আন্দোলন৷

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন চলে বছরব্যাপী৷ তাতে সফলতাও আসে৷ এই আন্দোলনের প্রভাব ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পড়েছিল৷ সেখানেও কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়৷ ওই বছরেরই ২৯ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এসেছিল৷ এর ফলে নিরাপদ সড়ক আইন হয়, যদিও তা এখনো কার্যকর হয়নি৷

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর ওই দিন থেকেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল৷

আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল ২০১৫ সালের জুন মাসে৷ বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার ওপর শতকরা ১০ ভাগ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল৷ পরে আন্দোলনের মুখে সেই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়৷ এখন চলছে সব ধরনের গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া বা হাফ পাসের আন্দোলন৷ এই আন্দোলন চলার মধ্যেই গত ২৪ নভেম্বর ঢাকায় নটরডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে পিষ্ট হয়ে নিহত হন৷ ওইদিন থেকে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনও শুরু করেন শিক্ষার্থীরা৷ তারা এখন ৯ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন৷ বাস মালিকরা শুধু ঢাকায় ছাত্রদের হাফ পাসের দাবি শর্ত সাপেক্ষে মেনে নিলেও ছাত্ররা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷ তারা সারা দেশে সব সময় সব গণপরিবহণে অর্ধেক ভাড়ার দাবি জানিয়েছেন৷

গত এক দশকের প্রতিটি আন্দোলনেই হামলা হয়েছে৷ হামলার অভিযোগ শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ৷ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে৷ পুলিশ হামলা করেছে৷

সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে পরিচিতি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল হক নুর৷ পরে তিনি ডাকসুর ভিপিও নির্বাচিত হন৷ নুরুল হক নুর বলেন, ‘‘এখন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করে না৷ মূল দল বা মাদার সংগঠনের অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করে৷ তারা সরকারের সাফল্য প্রচার, মন্ত্রী- এমপিদের প্রটোকল আর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের কাজ করে৷ এর বিনিময়ে তারা টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি করে৷ সাধারণ ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে তারা কাজ করে না৷ করার সময়ও নেই৷’’

তিনি জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে পাওয়া যায়নি৷ বামপন্থি ও বিএনপির ছাত্র সংগঠনগুলো বলেছে তোমরা কর আমাদের সমর্থন আছে৷ আর সরকারের ছাত্র সংগঠন তো উল্টো ভূমিকা পালন করেছে৷ তারা অবশ্য সরকার যা করতে বলেছে তা-ই করেছে বলে জানান নুর৷ আর বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতারা অনেকেই অছাত্র, তাই ছাত্রদের সাথে তাদের যোগাযোগ থাকে না৷ ছাত্রদের নিয়ে তারা কাজও করে না৷

এখন চলমান ছাত্র আন্দোলনে কেন যুক্ত হচ্ছেন না প্রশ্ন করলে নুর বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার সব কিছুইতেই রাজনৈতিক রঙ দিতে চায়৷ আমি যেহেতু এখন রাজনীতি করি, তাই যুক্ত হচ্ছি না৷ তবে আমাদের ছাত্র সংগঠন আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছে৷’’

নিকট অতীতে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় আন্দোলন এরশাদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন৷ ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অনেক বড় ভূমিকা ছিল৷ সেই আন্দোলনে ছাত্র নেতাদের একজন ডাকসুর সাবেক জিএস এবং বর্তমানে বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকন৷ তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রদের সমস্যা, বিশেষ করে আবাসিক সমস্যা, পড়াশোনার সমস্যা এসব নিয়ে এখন আর ছাত্রনেতারা আন্দোলন করেন না৷ তারা ছাত্রনেতা হলেও ছাত্রদের সাথে নেই৷

এটা একটা বড় ধরনের অবক্ষয়৷ দুর্নীতি, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও তারা আর সোচ্চার নয়৷ এখন সরকারি দলের ছাত্রনেতারা বরং সরকারের নানা অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে৷ এই কারণেই কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, হাফ ভাড়ার আন্দোলনের ওপর হামলা হয়৷ ছাত্রদের পক্ষে তারা নেই৷’’ তার মতে, ‘‘একটি রাষ্ট্রের যখন মাথায় পচন ধরে, তখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷’

ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, এখন ছাত্র রাজনীতি বলতে কিছু নেই৷ তাই সাধারণ ছাত্ররাই এখন নিজেদের দাবি নিয়ে নিজেরাই মাঠে নামছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সময় সাধারণ ছাত্ররা তাদের নানা সমস্যা, দাবি নিয়ে আমাদের কাছে আসতো৷ আমরা সেটা নিয়ে কাজ করতাম৷ কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতি বিরাজনীতিকরনের কারণে তাদের কাছে সাধারণ ছাত্ররা যায় না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন যারা ছাত্র রাজনীতি করে, তারা তাদের দল বা সরকারের জন্য কাজ করে৷ ছাত্রলীগ শেখ হাসিনার জন্য কাজ করে৷ আর ছাত্রদলকে তো কোথাও দেখাই যায় না৷ ছাত্রদলের ব্যর্থতা আর ছাত্রলীগের প্রতি ক্ষোভ সাধারণ ছাত্রদের৷ তাই তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য মাঠে নামছে৷ আর ছাত্র নেতারা গিয়ে ওই ছাত্রদের ওপর হামলা করে৷’’

চলমান ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ছাত্র তাসলিম ইসলাম অভি বলেন, ‘‘আমাদের আন্দোলন অরাজনৈতিক৷ তাই আমরা চাই না আমাদের আন্দোলনে এসে কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ফায়দা নিক৷ কারণ, এই আন্দোলন তাদের করা উচিত ছিল৷ তারাও তো ছাত্র৷ কিন্তু তারা করেনি৷ এখন তাদের দরকার নেই৷’’

তার কথা, ‘‘আমরা ছাত্র নেতাদের দেখি মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন৷ তারা এলে সেখানে তারা ভিড় করেন৷ নেতা-নেত্রীর নামে স্লোগান দেন৷ আমাদের নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই৷ তাই তাদের কাছে আমরা যাই না৷ আমরাই আমাদের দাবি আদায় করে নেবো৷’

এসএইচ-০৭/০৫/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)