ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে?

সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে এবার অভিযোগ উঠেছে বউ পেটানো ও হত্যার হুমকির৷ তারপরও তিনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷

মুরাদ হাসানের স্ত্রী ডা. জাহানারা এহসান বৃহস্পতিবার ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান৷ তার অভিযোগ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডা. মুরাদ হাসান তাকে ও তার সন্তানদের মারধর ও হত্যার হুমকি দিচ্ছেন৷ ফোন পেয়ে পুলিশ তাদের ধানমন্ডির বাসায় যায়৷ কিন্তু ততক্ষণে মুরাদ হাসান বাসা ছেড়ে চলে গেছেন৷

এরপর তার স্ত্রী একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন৷ জিডিতে তিনি বলেন, তাদের ১৯ বছরের বিবাহিত জীবন৷ তাদের একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে৷ তার স্বামী সাম্প্রতিক সময়ে তাকে এবং তার সন্তানদের কারণে-অকারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছেন৷ বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে তিনটার দিকে একইভাবে তাকে ও তার সন্তানদের গালাগাল করেন এবং মারধরের চেষ্টা করেন৷ এরপর তিনি (ডা. জাহানারা এহসান) ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করেন৷ কিন্তু পুলিশ আসার আগেই মুরাদ হাসান বের হয়ে যান৷

তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় আছি৷ আমার স্বামী যে-কোনো সময় আমার এবং আমার সন্তানদের ক্ষতি করতে পারে৷’’

জিডির তদন্ত করছেন ধানমন্ডি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত মুরাদ হাসানকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা নেই৷ আমরা প্রাথমিকভাবে তদন্ত করছি৷ এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবো৷ তখন যদি মনে হয় অপরাধ মামলার মতো, তাহলে মামলা হবে৷ আর গ্রেপ্তারের প্রশ্ন তখন আসবে৷ আমরা তখন প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে তাকে গ্রেপ্তারে উদ্যোগী হবো৷’’

জিডির ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি সেনসিটিভ৷ আর আমরা যাওয়ার আগেই তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান৷’’

যে ধরনের অপরাধ তাতে সরাসরি মামলা না নিয়ে কেন জিডি নেয়া হলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তার স্ত্রী মামলা করতে চাননি, তাই আমরা জিডি নিয়েছি৷’’ তবে চেষ্টা করেও এ বিষয়ে মুরাদ হাসানের স্ত্রীর কোনো মন্তব্য জানা যায়নি৷

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য এবং একজন চিত্র নায়িকাকে টেলিফোনে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার অডিও ফাঁস হওয়ার পর মুরাদ হাসান প্রধানমমন্ত্রীর নির্দেশে গত ৭ ডিসেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন৷ এরপর তিনি ক্যানাডা যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেদেশে ঢুকতে না পেরে দেশে ফেরত আসেন৷ এরপর দেশের অন্তত ৩০ টি জেলার আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন হয়৷ কিন্তু সব মামলাই খারিজ হয়ে যায়৷ ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালেও তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিলেন দুই আইনজীবী৷ কিন্তু আদালত দুটি মামলাই খারিজ করে দিয়েছেন৷

ঢাকার আদালতের দুটি মামলার একটির বাদী ছিলেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকি৷ তিনি বলেন, ‘‘আদালত বলেছেন, মুরাদ হাসানের বক্তব্যে আমি নিজে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না৷ এই কারণে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন৷’’ তবে তার কথা, ‘‘এর আগে সারাদেশে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, মাহফুজ আনাম ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ তখন আদালত মামলা নিয়েছেন৷ কিন্তু এখন নিচ্ছেন না৷ তাতে স্পষ্ট যে মুরাদ হাসান আইনের সুবিধা পাচ্ছেন৷ আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে না৷’’

তিনি জানান, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতি ৬৪ জেলায়ই মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ অনেক জেলায় মামলা হয়েছে৷ আবার পরিস্থিতি দেখে অনেক জেলায় মামলা করাও হয়নি৷

মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকার শহবাগ থানায়ও একটি মামলা করা হয়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুলিয়াস সিজার তালুকদার মামলাটি করেছিলেন ৭ ডিসেম্বর৷ কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, ‘‘আমরা ওই ছাত্রের অভিযোগকে মামলা হিসেবে নেইনি৷ আবেদন হিসেবে নিয়েছি৷ ওই আবেদনের ওপর এখন কোনো তদন্ত হচ্ছে না৷ আমরা ডিএপির জিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেলে আবেদনটির ওপর মতামত চেয়েছি৷ এখনো মতামত পাইনি৷ মামলা করার পক্ষে মতামত এলে মামলা হবে৷’’

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘মুরাদ হাসান নারীদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে পুরো নারী সমাজেরই অপমান, অবমাননা হয়েছে৷ সুতরাং যে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করতে পারেন৷ এখানে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো বিষয় নেই৷ নিম্ন আদালত মামলা না নিলে উচ্চ আদালতে যাওয়া যায়৷ আর নারী সংগঠনগুলোও তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে৷ এখানে সরকার ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে৷ পুলিশ সরাসরি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ তিনি একজন সংসদ সদস্য৷ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সংদদেরও৷’’

মুরাদ হাসানের স্ত্রীর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘তিনি যে অভিযোগ করেছেন তাতে অপরাধ সংঘটন হয়ে গেছে৷ এখানে মামলা হবে৷ জিডি তখনই হয় যখন অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা থাকে৷ আর পুলিশ মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতেই আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে৷ কিন্তু এই ক্ষেত্রে মুরাদ হাসানকে সুবিধা দেয়া হয়েছে৷”

এসএইচ-০২/০৮/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)