ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের উদ্যোগ

দেশের বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে দেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ।

কয়েক বছর ধরে মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবাদিকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগের অভিযোগ তুলে এই আইন বাতিলের দাবি করে আসছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক স্বীকার করেছেন, এই আইনের কিছু অপপ্রয়োগ হচ্ছে বলে তারাও মনে করছেন।

”এই অপপ্রযোগ বন্ধের জন্য আইনের দূর্বলতা বা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন।

গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার কর্মীদের বিরোধীতা সত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছিল ২০১৮ সালে।

আইনটি কার্যকর করার পর থেকেই গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর এর অপপ্রয়োগের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে।

সরকার আগে অপপ্রয়োগের অভিযোগ আমলে নেয়নি।

এখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক স্বীকার করেন যে, ‘এই আইনে কিছু অপপ্রয়োগ হচ্ছে।’

তিনি জানিয়েছেন, অপপ্রয়োগ বন্ধে কী করা প্রয়োজন এবং বিশ্বের অন্য দেশে ডিজিটাল অপরাধ দমনে কোন ধরনের আইন আছে-এ ব্যাপারে তিনি ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে দুই দফা আলোচনা করেছেন।

এখন তিনি তার মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন এবং এই কমিটি আইনের দূর্বলতা বা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে।

এই কমিটি কয়েকদিনের মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করবে।

মন্ত্রী বলেন, বাক স্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব বা বন্ধ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয় নাই।

”ব্যাপারটা হচ্ছে, আজকের পৃথিবীতে সাইবার অপরাধ একটা সমস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আইনটি করা হয়েছে,” তিনি বলেন।

“এখন আমরা দেখলাম, এই আইনটা প্রয়োগ করতে গিয়ে যারা মামলা মোকদ্দমা করছেন, এখানে কিছু অপব্যহার এবং দুর্ব্যবহার দু’টোই হচ্ছে” বলেন মি: হক।

তিনি আরও বলেন, “সেটা আমরা আলাপ আলোচনায় দেখবো যে, কোথাও কিছু সংশোধন করলে এর প্রায়োগিক দিক থেকে অপব্যবহার এবং দুর্ব্যবহার বন্ধ করা সহজ হবে- সেটা আমরা করতে রাজি আছি।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের বড় অভিযোগ হচ্ছে, এই আইনে মামলা হওয়ার সাথে সাথেই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সাংবাদিকরা বা গণমাধ্যম কর্মীরাই বেশি অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন।

ক্ষমতাসীনদলের সাথে সম্পৃক্ত এবং প্রভাবশালীরাই বেশিরভাগ মামলা করেছেন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই আইন নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনা করেছে।

সেই প্রেক্ষাপটে কিছুদিন ধরে সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনে অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে সাংবাদকিদের গ্রেপ্তার না করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সাংবাদিকসহ যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই যেন তাকে গ্রেপ্তার করা না হয়, সেই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তার আলাপ হয়েছে।

“আমি বলেছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কেই অভিযোগ করলে সেই অভিযোগের সমর্থনে নিশ্চিত তথ্য প্রমাণ না থাকলে অভিযুক্ত কোন সাংবাদিক বা কোন নাগরিককে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়।”

হক জানিয়েছেন, পুলিশের উর্ধ্বতন পর্যায়ে এসব মামলা দেখার জন্য একটি সেল আছে।

তিনি বলেছেন, নিশ্চিত তথ্য প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ এলেই মামলা না নিয়ে সেই অভিযোগ পুলিশের সেলে পাঠাতে হবে। সেই সেল তদন্ত বা পরীক্ষা করে মামলা নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত দেয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু মামলা হলেই সাথে সাথে গ্রেপ্তার না করা বা অভিযোগ এলেই তা যাচাইয়ের আগে মামলা না নেয়া-এই পদক্ষেপগুলো এখন সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নেয়া হচ্ছে।

কিন্তু এ ব্যাপারে আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন হবে নাকি আইন কার্যকরের বিধির মাধ্যমে করা যাবে -এসব পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।

দেরিতে হলেও অপপ্যযোগের ব্যাপারে সরকারের উপলব্ধিকে মানবাধিকার কর্মীরা ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, তারা আইনটিই বাতিলের দাবি করে আসছিলেন। এখন দেরিতে হলেও আইনের সংশোধনের যে উদ্যোগটুকু নেয়া হয়েছে,সেটিকেও তারা ইতিবাচক হিসাবে দেখেন।

“এই আইনে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হলো না, কিন্তু কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হলো, এখন পর্যন্ত যে ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে অপপ্রয়োগ দেখেছি, তার সাথে কোন তফাৎ থাকলো না।

”তাহলে সাথে সাথে গ্রেপ্তার হলো না, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার ওপর কোন শাস্তি বর্তানো হলো-এ সব আমাদের দেখার বিষয় আছে,” তিনি বলেন।

তবে সরকার শেষ পর্যন্ত আইনের সংশোধন করবে কীনা -এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যম কর্মীদের অনেকে।

সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, “যারা স্টেকহোল্ডার, তাদের সাথেতো সরকার আলোচনা করছে না। কী করলে ভাল হয় বা কোথায় সংশোধন করা প্রয়োজন-এই নিয়েতো কোন আলোচনা করা হচ্ছে না।”

তাহলে তারা যে সংশোধন করবে-এই ভরসাটা কোথায়? -এমন প্রশ্ন করেন মোস্তফা ফিরোজ।

আইনমন্ত্রী দাবি বলেছেন, আইনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে যে কমিটি করা হয়েছে, সেই কমিটি কয়েকদিনের মধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবে।

এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির সাথেও তারা আলোচনা করবে।

মন্ত্রী উল্লেখ করেন, এসব আলোচনা থেকে সমস্যা যা চিহ্নিত হবে, তার ভিত্তিতে সরকার পদক্ষেপ নেবে।

এসএইচ-০১/২২/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)