গুম: নিখোঁজদের ব্যাপারে পুলিশি তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ পরিবারগুলোতে

বিয়ের পর মাত্র চার বছর সংসার করে আট বছর ধরে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা ফারজানা আক্তার। দুই সন্তান নিয়ে তার কঠিন সংগ্রাম। নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে ২০১৩ সালে ধরে নেয়ার পর থেকে তার স্বামীর কোনো হদিস নেই।

ফারাজানার স্বামী পারভেজ হোসেন ছিলেন পুরনো ঢাকার বংশাল এলাকার ছাত্রদল নেতা । ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগের মাসে শাহাবাগ থেকে পারভেজসহ চারজন একসঙ্গে নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তাদের কেউ ফিরে আসেনি।

সম্প্রতি পুলিশ পারভেজের বংশালের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে দাবি করে ভিকটিমের পরিবার। পারভেজের মায়ের নম্বর থেকে ফোন করে পুলিশ ফারজানাকে দেখা করার জন্য বলেছে।

ফারজানার সন্দেহ কী উদ্দেশ্যে পুলিশ নতুন করে যোগাযোগ শুরু করেছে।

“আামাকে বলছে দেখা করতে। কিন্তু আমি করি নাই। ফুসলায়া-ফাসলায়া সিগনেচার নিয়া মনে হয় পুলিশ তাদের দায়ভার থেকে মুক্ত হইতে চাইতেছে।”

ফারজানার প্রশ্ন: “আট বছরেও কেন পুলিশ তার স্বামীকে খুঁজে বের করতে পারলো না?”

“উপর থেকে নির্দেশ না দিলে উনারা (পুলিশ) কোথায় আছে, কীভাবে আছে বলবে না। আপনারা মন্ত্রীদের কথা শোনেন না – ওনারা কীভাবে কথা বলেন! ওনাদের কথা থেকে কী বোঝা যায়? তারা বলে আমাদের লোক বিয়ে করে চলে গেছে, নিজেরা নিজেরা ঋণের দায়ে লুকায়ে আছে!”

দেশে অনেক পরিবারের দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নেয়ার পর থেকে তাদের স্বজনরা গুম হয়ে গেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরকম ৮৬ জনের এখনো কোনো হদিস বের করা যায়নি।

সবুজবাগের মাহাবুব হাসান সুজন এবং কাজী ফরহাদ নিখোঁজ হন ২০১৩ সালে নারায়নগঞ্জ থেকে।

সুজনের মা রাশিদা বেগম বলেন, ১০ই জানুয়ারি সবুজবাগ থানার কয়েকজন পুলিশ তাদের বাড়িতে যায় এবং জিডির কপি এবং জবানবন্দী লিখে স্বাক্ষর চায়।

তবে তার স্বামী সেটিতে স্বাক্ষর করেননি, কারণ পুলিশ আগে থেকে লিখে আনা একটি চিঠি দিয়ে তাদেরকে হুবহু লিখে সই করতে বলার কারণে।

“যে অবস্থা করছে। পুলিশ আইসা জোর করে সিগনেচার নিতে চায়। বলে চলেন আপনি থানাতে চলেন, ওর বাবাকে বলে।”

সুজনের পরিবারের দাবি, তাদেরকে যে জবানবন্দী লিখে স্বাক্ষর দিতে চাপ দেয়া হয়েছিল, সেখানে উল্লেখ ছিল যে তারা তথ্য আড়াল করে ভুল তথ্য দিয়ে জিডি করেছিল।

এ বিষয়ে সবুজবাগ থানার ওসির সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলে তিন বলেন, ধারাবাহিক তদন্তের স্বার্থে তারা যোগাযোগ করেছেন।

তাদের লিখে দেয়া জবানবন্দীতে স্বাক্ষর বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজী হননি।

সম্প্রতি বেশকিছু ভিকটিম পরিবার জানিয়েছে, স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা যোগাযোগ করেছে নানারকম তথ্য চাইছে, এমনকি নতুন জবানবন্দীতে স্বাক্ষর নিচ্ছে।

ভিকটিম পরিবারগুলো বিষয়টিকে হয়রানি হিসেবে দেখছে এবং এর প্রতিবাদ করেছে। যদিও পুলিশ জানাচ্ছে তদন্ত এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে এই তৎপরতা।

ঢাকা মেট্রোপলিটল পুলিশের মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মো: ফারুক হোসেন বলেন, “তদন্ত এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই পরিবারগুলোর কাছে যাচ্ছে পুলিশ।”

“হয়রানির কোন বিষয় না। নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য তদন্তকে শেষ করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই ওই ভিকটিমের বাড়িতে যেতে হবে।”

“তথ্য নিতে হবে এবং এই মামলার প্রক্রিয়াটাকে শেষ করতে হবে। সেই শেষ করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কিন্তু আমরা ভিকটিমের ফ্যামিলির কাছ থেকে তথ্য সহায়তা আমরা চাচ্ছি। এই কারণেই তাদের বাড়িতে যাওয়া।”

ফারুকের কথায় বোঝা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে তদন্তে পুলিশ নতুন করে সক্রিয় হয়েছে।

“যেই ব্যক্তিদেরকে এখন পর্যন্ত আমরা উদ্ধার করতে পারি নাই, তাদের ব্যাপারে আমাদের যেসব অফিসার অ্যাসাইন্ড করা আছে ,তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেই বিষয়টা আমরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনিটরিং করছি।”

“যতদ্রুত সম্ভব তাদেরকে খুজেঁ বের করা যায় সেজন্য আমরা আন্তরিকভাবে আরো অ্যাকটিভলি কাজ শুরু করেছি।”

গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম আঁখি। ২০১৩ সালে আঁখির ভাইসহ ৮জনকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

আঁখি মনে করেন, “আন্তর্জাতিক চাপের কারণে পুলিশ নতুন এ তৎপরতা শুরু করেছে।”

তিনি বলেন, গত বছর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি ৩৪ জনের একটি তালিকা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে। ওই তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের সবার বাড়িতে নতুন করে পুলিশ গিয়েছে।

তবে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের পুলিশের তদন্তে গুমের শিকার পরিবারগুলোর কোন আস্থা নেই।

“বিদেশ থেকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো, জাতিসংঘ চাপ দিচ্ছে। তারা চাপের মুখে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের সরকারের কাছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি বার বারই আসতে চাইছে।”

“কিন্তু তাদেরকে অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। তাদেরকে আসতে দেয়া হোক। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সুন্দরভাবে করা হোক।আমরা আমাদের স্বজনদের ফেরত চাই। যারা খুন হয়েছে, তাদের হত্যার বিচার চাই।”

গুম পরিস্থিতি নিয়ে দেশি বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন বরাবরই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নড়ে চড়ে বসেছে আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি আলোচনায় আসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের গ্রহণের পর।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন গুম পরিস্থিতির একজন পর্যবেক্ষক। পুলিশের নতুন তৎপরতার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “একটা হচ্ছে জাতিসংঘের তরফ থেকে প্রতিবেদেন চাচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কালের সিদ্ধান্ত। রেসট্রিকশন। তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।”

মি.লিটন বলছেন, “সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে যে অন্যান্য যে কোনো সময়ের চাপের চেয়ে এই সময়ে চাপটি খুব প্রবলভাবে আসছে। তাতে মনে হচ্ছে যে এই বিষয়টাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।”

“এই চাপটি শেষ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিব্রবতকর অবস্থায় ফেলে দেবে যদি কিনা তারা যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়।”

জানা যায়, বিভিন্ন সময় গুম পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্নে বাংলাদেশের জবাবে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এবার ঢালাও বক্তব্য না দিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ।

তবে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের তদন্তের বাস্তবতায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এসএইচ-০২/২৩/২২ (আবুল কালাম আজাদ, বিবিসি)