সাইবার দুনিয়ার জেরে অপরাধও বাড়ছে!

বাংলাদেশে ধীরে ধীরে সাইবার দুনিয়ার জেরে প্রচলিত অপরাধও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতারণা, হয়রানি, যৌন হয়রানি বা হুমকি ছাড়িয়ে এখন খুনোখুনিও হচ্ছে সাইবার জগতের প্রভাবে। যাকে বিশ্লেষকেরা অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন।

র্বশেষ ঢাকার কাছে গাজীপুরে ফেসবুক স্ট্যাটাসে কমেন্ট রিঅ্যাক্টকে কেন্দ্র করে তিনজন হত্যার শিকার হয়েছেন। এর আগে ফেসবুকে হত্যার প্ল্যান করে বাস্তবে তা কার্যকর করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে কিশোর গ্যাং-এর অপরাধ পরিকল্পনা, অপরাধ সংঘটন, গ্রুপ তৈরি প্রায় সব কিছুই এখন ফেসবুক কেন্দ্রিক।

ফেসবুকে এসে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন এখন আর ভার্চুয়াল ও বাস্তবের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। তারা বলছেন, সাইবার অপরাধ বলতে ভার্চুয়াল দুনিয়ার কিছু অপরাধ বোঝানো হলেও এই দুইটি এখন একাকার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে প্রচলিত অপরাধ যুক্ত হয়ে অপরাধ যেমন বাড়ছে তেমনি অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় রোববার এক নারীকে নিয়ে ফেসবুক পোস্ট এবং তাতে হা হা রিঅ্যাক্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষে রূপ নিয়ে তিন পরিবারের তিন তরুণ নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো পাঁচ জন। তবে এটাই প্রথম নয়।

এর আগেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস ও কমেন্ট নিয়ে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ২৬ নভেম্বর গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নারীসহ ৪০ জন আহত হন । তিন ঘণ্টাব্যাপী ওই সংঘর্ষে ৫০টির বেশি ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ফেসবুক পোস্টটি ছিলো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ওই সংঘর্ষ থামাতে পুলিশকে গুলি ছুড়তে হয়।

ত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় ফেসবুক পোস্টের জের ধরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নারীসহ ১৫ জন আহত হন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পোস্টের জেরে ওই সংঘর্ষ হয়। ওই এলাকায় তখন পুলিশ মোতায়েন করতে হয়।

বাংলাদেশে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে বা ধর্মীয় উসকানি ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কৌশল বেশ পুরনো। অন্যদিকে প্রতিবাদী ফেসবুক পোস্টের কারণে হামলা, নির্যাতন এবং মামলার ঘটনাও নতুন নয়। নারীরাই আবার ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শিকার হচ্ছেন ব্ল্যাক মেইলিং-এর। আর নানা আর্থিক প্রতারক চক্র দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এর বাইরে হ্যাকার গ্রুপ তো আছেই। হ্যাকিং করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি তো সবার জানা।

কিন্তু এখন এই ফেসবুককে কেন্দ্র করে পরিবার, গ্রাম ও ব্যক্তি পর্যায়ে সংঘাত সংঘর্ষ বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট বা রিঅ্যাক্ট-এর প্রভাবে বাড়ছে সংঘাত সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ড।

সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক তানভীর হাসান জোহা একে অশনি সংকেত উল্লেখ করে বলেন,”এখন মোবাইল ফোনের ব্যবহার অনেক বেড়েছে সেই কারণে ইন্টারনেটে সুবিধাও বেড়েছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে । কিন্তু এগুলো ব্যবহারের জন্য এখানকার মানুষ প্রশিক্ষিত না বললেই চলে। জাতীয় পর্যায়েও নেই কেনো গাইড লাইন। ফলে এখন এটাকে কেন্দ্র করে বাস্তব জীবনে সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে।”

তিনি বলেন,”কেউ কারো বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছু ফেসবুকে লিখলেন যিনি তার পরিচিত। যার বিরুদ্ধে লিখলেন তিনি একই এলাকার হওয়ায় লেখার মাধ্যমে জবাব দেয়ার ধৈর্য হারিয়ে সরাসরি প্রতিশোধ নিতে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।”

তার মতে, প্রধানত দুইটি কারণে এই পরিস্থিতি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নীতিমালা না থাকা এবং ক্ষতিগ্রস্তরা আইনি প্রতিকার না পাওয়া বা প্রতিকার পাওয়ার আইন সম্পর্কে সচেতন না থাকা।

তার মতে,”এখনো এ সংক্রান্ত আইন প্রভাবশালীদের স্বার্থরক্ষা ও অন্যদের হয়রানি করতে ব্যবহার করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্বাধীন মত প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্মও।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান মনে করেন, সাইবার অপরাধের বিচারহীনতার কারণে তার জেরে প্রচলিত অপরাধ বাড়ছে। বিচার না পেয়ে কেউ কেউ সরাসরি প্রতিরোধে নেমে নিজেই হত্যা, সংঘর্ষের মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। একটি মেয়েকে সাইবার জগতে চরম হয়রানি করা হয়। বিচার পায় না। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে।

তার কথা,”প্রযুক্তির বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই এরকম ঘটনা আমরা লক্ষ্য করি। তবে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন যেমন কার্যকর করা প্রয়োজন তেমনি সচেতনতা বাড়ানো খুব জরুরি। সবচেয়ে জরুরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের শিক্ষিত করা।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন,”আমরা সাইবার পেট্রোলিং আরো জোরদার করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানি বা সংঘাতমূলক কোনো পরিস্থিতি হচ্ছে কী না তা আমরা মনিটর করি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই। তারপরও যেসব অপরাধ ঘটে তার জন্য তো আইনগত ব্যবস্থা আছেই। সেটা নেয়া হয়।”

তবে তার মতে,”এটা প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সচেতনতা। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব পর্যায়ে সচেতনতার কাজ করতে হবে। এজন্য আমাদেরও নানা কর্মসূচি আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা পর্যায়ে আমরা সচেতনতার কাজ করি।”

এসএইচ-০১/১৫/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে))