ডলার বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ডলারের অস্থির বাজার সামলাতে বৈধ পথে রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য শর্ত শিথিল করে কর্তৃপক্ষ বলেছে, পাঁচ হাজার ডলার বা তার বেশি রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে কোন কাগজপত্রের প্রয়োজন হবে না।

দেশটির রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আনার ব্যাপারেও পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান আবারও কমিয়েছে। সোমবার প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্য ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর আগে বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও দেশে ব্যাংকগুলোর সাথে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য যেহেতু অনেক বেশি থাকছে, ফলে প্রবাসীদের হুন্ডির মাধ্যমে বা অনানুষ্ঠানিক পথে রেমিটেন্স পাঠানো প্রবণতা বেড়েছে।

এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই কর্তৃপক্ষ রেমিটেন্স পাঠানোর শর্ত শিথিল করে বলেছে, পাঁচ হাজার ডলার বা তার বেশি রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে কোন কাগজপত্রের প্রয়োজন থাকবে না। একই সাথে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা পাওয়া যাবে।

এতদিন রেমিটেন্সের পাঠানোর সময় তার সমর্থনে কাগজপত্র বাধ্যতামূলক ছিল।

এছাড়া রপ্তানির আয় যাতে দ্রুত দেশে আনা যায়, সে ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।

একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ওয়ান ব্যাংকের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার পারুল দাস বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তারা আলোচনা করে পদক্ষেপ নেবেন।

তবে ডলারের বাজারে তার কতটা প্রভাব পড়বে-সেই প্রশ্ন থেকে যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে প্রণোদনা দুই শতাংশের জায়গায় আড়াই শতাংশ করার বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসাবে দেখেন।

কিন্তু এই ব্যাংক কর্মকর্তার বক্তব্য হচ্ছে, এখনও ডলারের অফিসিয়াল দাম এবং খোলাবাজারের দামে পার্থক্য অনেক বেশি।

এই ফারাকটা যতক্ষণ না কমছে, ততক্ষণ পর্যন্ত রেমিটেন্সের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা রাখবে কি না, – সেই প্রশ্ন তার রয়েছে।

পারুল বিশ্বাস বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা তারা কার্যকর করার চেষ্টা করবেন।

কিন্তু তিনি উল্লেখ করেন, রেমিটেন্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাকগুলোর তেমন ভূমিকা থাকে না। রপ্তানির আয় দ্রুত আনার প্রশ্নে তারা এখন রপ্তানিকারকদের সাথে আলোচনা করবেন।

আরেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ডলারের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নির্ধারিত দামে রেমিটেন্স এবং রপ্তানির অর্থ দেশে আনার নির্দেশ দিচ্ছে।

বিদেশে রেমিটেন্স এক্সচেঞ্জগুলো এবং রপ্তানিকারকরাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সেই দামের অনেক বেশি চাইছে। ফলে ব্যাংকগুলো দুই দিক থেকে সমস্যায় পড়েছে।

টাকার মান সর্বশেষ ৪০ পয়সা কমিয়ে প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই মে মাসেই এনিয়ে তিন দফায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো হলো।

কিন্তু এরপরও আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামের তুলনায় বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন আমদানিকারকরা।

তারা বলেছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে ৯৫ টাকার বেশি দর রাখছে।

বন্দরনগরী চ্ট্গ্রাম থেকে অন্যতম একজন আমদানিকারক ড: মুনাল মাহাবুব বলেছেন, সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো মাঠ পর্যায়ে সেভাবে এখনও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

আমদানিকারকদের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অবশ্য বলছে, ডলারের অস্থির বাজারে আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে দু’দিন ধরে দুই তিন টাকা করে কমেছে।

খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দু’দিন ধরে খোলাবাজারেও একশো টাকার নীচে নেমেছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশ থেকে রপ্তানি বেড়েই চলেছে। টাকা মান কমানোর ফলে প্রবাসীরাও রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছেন।

কিন্তু গত নয় মাসে দেশে আমদানি ব্যয় হয়েছে আট হাজার তিনশো কোটি ডলার। সেখানে রপ্তানি বাড়ার পরও তা দাঁড়িয়েছে চার হাজার পাঁচশো কোটি ডলারে। এতে বড় ঘাটতি থাকছে।

যদিও এখন রিজার্ভ রয়েছে চার হাজার দু’শো কোটি ডলারের বেশি।

কিন্তু সম্প্রতিক সময়ে আমদানি যে হারে বেড়েছে, তাতে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।

অর্থনীতিবিদ ড: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পদক্ষেপে ডলারের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ডলারের খোলাবাজারের ওপর নজরদারি করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি সরকারি বেসরকারি সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ব্যাংক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করার পাশাপাশি বিলাসী পণ্য আমদানির শুল্ক মার্জিন যে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে, এই শুল্ক মার্জিন প্রয়োজনে একশো শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।

এছাড়া নিয়মিত পর্যালোচনার ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

ইসলাম বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চারটি টিম বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ইন্সপেকশন করছে।

“তারা (ব্যাংকগুলো) যে দামে ডলার দেয়ার কথা, সেই দামে দিচ্ছে কিনা বা কোন রেটে তারা দিচ্ছে। এব বিষয় কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল দেখছে” বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।

বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে খোলাবাজার এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে যে ডলারের দাম কিছুটা কমেছে, সেটাকেই স্বস্তি হিসাবে দেখছে কর্তৃপক্ষ।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও মার্কিন ডলার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে ডলারের বাজারে অস্থিরতা লম্বা সময় চলতে পারে বলে তাদের ধারণা।

এসএইচ-১৯/২৩/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)