বিএনপি ‘বৃহত্তর ঐক্য’ কীভাবে অর্জন করতে চাইছে?

দেশে বিরোধীদল বিএনপি বর্তমানে সবগুলো সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনকে তাদের আন্দোলনে যুক্ত করার লক্ষ্যে এক সংলাপ শুরু করেছে।

‘শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়’-এই এক দফা দাবিতে বিএনপি অন্য দলগুলোর সাথে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ করে যুগপৎ আন্দোলনের চিন্তা নিয়ে এগুচ্ছে।

এদিকে এর আগে বিএনপির জোট গঠনের ক্ষেত্রে তাদের আন্দোলন বা নির্বাচনী জোটে নেতা কে হবেন, এ নিয়ে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল।

তবে এবার দলটির নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়াই হবেন তাদের ঐক্যের মুল নেতা। এই ঐক্যে এখনই কোন নির্বাচনী জোট হবে না।

বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীসহ যে ২০ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল তা এখন আর সক্রিয় নেই।

গত নির্বাচনের আগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামসহ কয়েকটি দলকে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের ভিন্ন আরেকটি যে জোট করেছিল, সেই জোটও ভেঙে গেছে অনেক আগে।

বিএনপি এককভাবেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে।

যদিও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পুরোনো দাবিকে সামনে এনে কিছুদিন ধরে বিএনপি দলগতভাবেই রাজপথে সমাবেশ বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে, কিন্তু দলটি মনে করছে যে এককভাবে তাদের এ দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলা সম্ভব হবে না।

সেজন্য বিএনপি নতুন কৌশল হিসাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী অন্য সব দলের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়েছে।

এখন এই ঐক্য তৈরির চেষ্টায় দলটি অন্যদলগুলোর সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলম আলমগীর বলেছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে তারা আন্দোলনের ঐক্য বা প্লাটফরম তৈরির চেষ্টা করছেন।

পুরোনো জোটগুলো সম্পর্কে মি: আলমগীরের বক্তব্য হচ্ছে, “সুনির্দিষ্টভাবে ২০ দলীয় জোট এখন এফেক্টিভ (কার্যকর) না। ঐক্যফ্রন্টও এফেক্টিভ না।”

তিনি উল্লেখ করেন, তারা এখন আন্দোলনের জন্য বৃহত্তর ঐক্যের চেষ্টা করছেন এবং প্রয়োজন হলে সেটাকে তারা নতুনভাবে রুপ দেবেন।

বিএনপি যেহেতু শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার অবস্থানকে এখন সামনে আনছে।

সেকারণে কৌশল হিসাবে আন্দোলনের ঐক্যকে এখনই নির্বাচনী জোট বলতে চাইছে না দলটি।

কিন্তু ঐক্যের প্রক্রিয়ায় বিএনপিসহ অন্য যে সব দল রয়েছে, সেই দলগুলোর নেতারা মনে করেন, আন্দোলনের মধ্যেই তাদের ঐক্য নির্বাচনী জোটে রূপ নিতে পারে।

আন্দোলনের ঐক্য বা যাই বলা হোক কেন – এই ঐক্যের নেতৃত্ব নিয়েও আলোচনা রয়েছে দলগুলোর মধ্যে।

গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বকে সামনে রেখে গণফোরামসহ কয়েকটি দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ড: হোসেনই সেই নির্বাচনে অংশ নেননি।

তখন তাদের জোটের নেতা কে বা কাকে দেখে ভোটাররা আকৃষ্ট হবেন – এসব নানা প্রশ্ন উঠেছিল।

এই বিষয়টি এবার ঐক্যের ক্ষেত্রে বিএনপি বিবেচনায় রেখেছে এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকেই সামনে রাখা হবে বলে দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

বিএনপি মহাসচিব মি: আলমগীর বলেছেন, ঐক্যের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নিয়ে কোন জটিলতা হবে না।

তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, “অন্য দলগুলোর সাথে আমরা যেহেতু আছি, তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ঐক্যের নেতা ঠিক হবে।”

একইসাথে মি: আলমগীর উল্লেখ করেছেন, “আমাদের দলের নেতা নি:সন্দেহে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আছেন। তার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আছেন তারেক রহমান।”

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দুই বছর জেলে খেটে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত রয়েছেন।

সেই শর্ত অনুযায়ী তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারবেন না। দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ায় তিনি নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন ন।

এছাড়া বয়স এবং অসুস্থতার কারণেও মিসেস জিয়া রাজনীতিতে এখণ সক্রিয় হতে পারবেন কিনা – সে প্রশ্নটিও রয়েছে।

তবে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও বিএনপি এখন কৌশল হিসাবে তার নেতৃত্বকেই সামনে রেখে এগুতে চাইছে।

এরফলে খালেদা জিয়ার মামলার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক একটা অবস্থান তৈরি করা সম্ভব হতে পারে এবং একইসাথে তাদের আন্দোলনে মানুষের সহানুভুতি পাওয়া যেতে পারে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন।

বিএনপির অন্য একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, তারা আসলে খালেদা জিয়ার নামেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে চাইছেন। সেখানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় নীতি নিয়ে তৎপর থাকবেন।

আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎ আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করবেন।

এনিয়ে বিএনপির সমমনা অন্য দলগুলোর কোন প্রশ্ন এবং আপত্তি নেই বলে মনে হয়েছে।

বিএনপি এখন রেজা কিবরিয়া এবং নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ এবং বামপন্থী দলগুলোর সাথে সংলাপ করবে।

ঐক্যের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বা অন্য কোন বিষয়ে প্রশ্ন নেই রেজা কিবরিয়ার।

তিনি বলেছেন, তারা এখন নির্বাচনী জোট না করে বিএনপিকে সামনে রেখেই সরকার বিরোধী আন্দোলনে আগ্রহী।

“বিএনপির ঐক্যের উদ্যোগ ইতিবাচক বলে মনে করি। কারণ বর্তমান সরকারের পতন এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফায় দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হবে” বলেন মি: কিবরিয়া।

তবে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট নিয়ে বিএনপিকে দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এবার বিএনপি কৌশলে জামায়াতকে যুগপৎ আন্দোলনে রাখতে চাইছে।

দু’দিন আগে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিএনপি ঐক্য গঠনের সংলাপ শুরু করেছে।

মি: মান্না বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত আলাদাভাবে অভিন্ন কর্মসূচিতে থাকবে, এমন আলোচনা তাদের মধ্যে রয়েছে।

“বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, বিভিন্নভাবে আমাদের জানিয়েছে যে, তারা জামায়াতকে নিয়ে কমফর্টেবল নয়। কাজেই জামায়াতকে আলাদা রাখা হবে।

“যুগপৎ আন্দোলন হবে। জামায়াত আলাদাভাবে বিএনপির সাথে কথা বলে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো। তাতে তো সমস্যা নাই” বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, বিএনপির এই নতুন কৌশল কার্যকর করা সম্ভব হলে তাতে বিএনপি রাজনৈতিক ফল পেতে পারে।

এদিকে, আওয়ামী লীগের সাথে থাকলেও এখন কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এমন কয়েকটি দল যেমন, জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবং শরিফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন জাসদের একাংশের সাথেও বিএনপি ঐক্যের ব্যাপারে আলোচনার চেষ্টা করবে বলে দলটির নেতারা বলছেন।

ঐক্যের ব্যাপারে বিএনপি প্রথম পর্যায়ে সংলাপ শেষ করার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আবার আলোচনা করবে।

সেই পর্যায়ে বিএনপি আন্দোলনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা করার কথা বলছে।

এসএইচ-১৯/২৭/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)