বিদ্যুৎ না দিলেও ভারতীয় কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে বাংলাদেশকে

বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দেশের শতভাগ এলাকা এখন বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এবং চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাও অনেক বেশি।

এ দাবি সত্ত্বেও সম্প্রতি পাঁচটি বেসরকারি ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ আরো দু’বছর বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি অনুসারে এবছরের শেষের দিকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করতে যাচ্ছে।

আবার সরকার একদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য রাত আটটার পর শপিংমল ও দোকানপাট বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে, অন্যদিকে বেশ কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রেখেই প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে, যার আনুষ্ঠানিক নাম ক্যাপাসিটি চার্জ।

এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে গত ২০২০-২১ অর্থবছরেই ৩৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বছরের অধিকাংশ সময় অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পিডিবিকে।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসেব অনুযায়ী দেশে এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫২টি। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে চলতি বছরের ১৬ই এপ্রিলে- ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। আর এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে ১১৬০ মেগাওয়াট।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি শামসুল আলম বলছেন সরকার যেসব চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলার ক্যাপাসিটি কিনেছে, গলদটা সেখানেই।

“দু’তিন গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে বলে ক্যাপাসিটি চার্জে এখন বিপুল অর্থ যাচ্ছে। একদিকে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকছে অথচ ভাড়ায় চালিত কেন্দ্রগুলোর সাথে চুক্তি বাড়ানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে নানাজনের স্বার্থ আছে বলেই এসব হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলার জন্য কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো।

তখন বলা হয়েছিলো যে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তৈরি হয়ে গেলে ধীরে ধীরে ভাড়ায় চালিত এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে বা সেগুলো থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার দরকার হবে না।

কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকার একদিকে এসব কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে আবার এসব কেন্দ্র বসে থাকলেও তাদেরকে টাকা দিতে হচ্ছে এবং এটিই হলো ক্যাপাসিটি চার্জ।

সরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে থাকে। অবশ্য তারা এটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দামের সাথেই যোগ করে দেয় বলে এনিয়ে ততটা আলোচনা হয় না।

জ্বালানি বিষয়ক সাময়িকী এনার্জি এন্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলছেন আপাতত এ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই। উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বাড়লেও জ্বালানি বিশেষ করে গ্যাসের অভাবে অনেক কেন্দ্র চালাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

“গ্যাসের অভাবে অন্তত ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হয়। আবার যুদ্ধের কারণে ৮/৯ ডলারের এলএনজির দাম ৫০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এসব কারণে ভাড়ায়-চালিত কেন্দ্রগুলোও রাখতে হবে। আর এগুলো রাখলে বিদ্যুৎ নিক বা না নিক- ক্যাপাসিটি চার্জ তো দিতেই হবে,” বলছিলেন তিনি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ারসেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন অবশ্য বলছেন তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেগুলোর সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের আর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে না।

“ভাড়ায়-চালিত তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কিন্তু এখন আর রেন্টাল নেই। শুরুতে বলেছিলাম যে দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য মাসে মাসে ভাড়া দিবো আর জ্বালানি খরচ দিবো। মেয়াদ শেষে তাকে ভাড়া দেয়া হয় না এবং নতুন করে মেয়াদ বাড়ালেও তাকে শুধু জ্বালানি ও লোকবল খরচ দিবো। আর ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ নীতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ না দিলে তাদের কোন পয়সা দেয়া হয় না,” বলছিলেন তিনি।

পাওয়ারসেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলছেন বাংলাদেশ ও ভারত- উভয়পক্ষের প্রস্তুতি অনুযায়ী ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হওয়ার কথা।

যদিও ২৫ বছর মেয়াদী এ চুক্তিটিকে অনেকেই অসম ও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করছেন।

ভারতের ঝাড়খণ্ডে ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা-ভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি করবে আদানি গ্রুপ। এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য ২০১৫ সালে আদানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে আদানির সঙ্গে ক্রয় চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।

এ চুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা হচ্ছে কারণ বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের কয়লা-ভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চেয়ে এখানে বেশি দাম ধরা হয়েছে।

একই সাথে আদানির বিদ্যুতের জন্য প্রতি বছর প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে।

বাংলাদেশ কেন ক্যাপাসিটি চার্জ দেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলছেন যে আদানি ওই প্লান্টটি করবে বাংলাদেশের জন্য।

“এখানেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যে কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় সেই একই কারণে আদানিকেও দিতে হবে। কারণ তারা বাংলাদেশের জন্য প্লান্টটি করবে,” বলছিলেন তিনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলছেন বাংলাদেশে যেসব বড় কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে সেগুলোসহ রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে আসার পর ভাড়ায়-চালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে।

“তবে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাজে পরিকল্পনার কারণে। চাহিদা বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রগুলো তৈরি করা হলে এমন হতো না। এখানে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই হয়েছে ব্যক্তি বা কোম্পানির আগ্রহে,” বলছিলেন তিনি।

মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলছেন গ্যাসের অভাবের কারণে গ্যাস-ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো তাদের সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে। অন্যদিকে জ্বালানি সরবরাহের কোন গ্যারান্টি নেই বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে।

“এ কারণেই পিক আওয়ারে তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনো অপরিহার্য্য। আর এগুলো থাকলে যে নামেই হোক তাদের চার্জ তো দিতে হবেই,” বলছিলেন তিনি।

মোহাম্মদ হোসাইন অবশ্য বলছেন বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ।

তার দাবি প্রতিটি চুক্তির সময় এসব বিবেচনার মাধ্যমে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করেই চুক্তিগুলো করা হয়।

এসএইচ-১৯/২১/২২ (রাকিব হাসনাত, বিবিসি)