মসলার চাষ শিখতে বিদেশ যাবেন ১৮ কর্মকর্তা

করোনাভাইরাসের অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্যে মসলার উন্নত জাত উদ্ভাবন ও এ সংক্রান্ত প্রযুক্তির সম্প্রসারণ বিষয়ক এক প্রকল্পে ১৮ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বৈদেশিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ হিসেবে দুই ব্যাচে ৯ জন করে ১৮ জনের বিদেশ সফরের ব্যয় রাখা হয়েছে ৯০ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এরই মধ্যে প্রকল্পটির প্রক্রিয়াকরণ শেষ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী বৈঠকে প্রকল্পটি উপস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মসলার জাত উদ্ভাবনের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)।

সূত্র জানায়, প্রকল্পটির প্রাথমিক প্রস্তাবে বিদেশে শিক্ষা সফর হিসেবে আরও বেশি কর্মকর্তার প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছিল। তাতে অর্থও ধরা হয়েছিল বেশি। গত ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পের এই অঙ্গটি নিয়ে আপত্তি জানানো হয়। এরপর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুই ব্যাচে ৯ জন করে ১৮ জন কর্মকর্তায় বিদেশ সফরের সংস্থান রাখার সুপারিশ দেওয়া হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, সেটি মেনে সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, পিইসি সভায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বিভিন্ন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর মধ্যে কৃষক প্রশিক্ষণ, কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা খাতে প্রস্তাবিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া পরামর্শক খাতে কনসট্রাকশন কনসালটেন্সি, বেইজলাইন সার্ভে, ইম্প্যাক্ট সার্ভে, ব্যস্থাপনা ব্যয়, গ্যাস ও জ্বালানি, কৃষক গ্রুপ গঠন, মধ্যবর্তী মূল্যায়ন, পলিশেড, কোল্প স্টোরেজ, গ্রিন হাউজ, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন মেরামত ও সংস্কার ইত্যাদি খাতে প্রস্তাবিত ব্যয় বাদ দিতে বলা হয়। পিইসি সভার সুপারিশ মেনে ২৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে বর্তমান ব্যয় ধরা হয়েছে।

প্রকল্পে বিদেশ সফরের সংস্থান রাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এ ধরনের ব্যয় কমিয়ে আনতে। এরই মধ্যে অনেকটা কমেও গেছে। তবে এই প্রকল্পের বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব ছিল দেখার। তারা যখন সব প্রক্রিয়া শেষ করে আমার কাছে দেয়, তখন আর তেমন কিছুই করার থাকে না।

মন্ত্রী বলেন, কমিশনের সদস্যদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে, তারা যেন সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেন। তবে বিজ্ঞানীদের কারবার সম্পর্কে তেমন কিছু বলারও থাকে না। তারপরও এ প্রকল্পের বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এই প্রকল্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মসলার অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এর বাজারমূল্যও অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে মসলার বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। দেশে প্রায় ৫০ ধরনের মসলা ব্যবহার হলেও মাত্র সাত ধরনের মসলাজাতীয় ফসল দেশে উৎপাদিত হয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার সিংহভাগই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, মসলার এই আমদানিনির্ভরতা কমাতে স্থায়ীভাবে মসলার উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্র এখন পর্যন্ত ২২টি মসলাজাতীয় ফসলের ৪৭টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট হারভেস্ট প্রযুক্তিসহ ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ সম্ভব হলে দেশে মসলার উৎপাদন ও কৃষকের আয় বাড়বে। সেই সঙ্গে আমদানিনির্ভরতা কমানো যাবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই দেশের ৪০টি জেলার ২৫টি হর্টিকালচার সেন্টারে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

এই প্রকল্পের আওতায় ২৮ হাজার ৬৫২টি মসলা প্রদর্শনী ও চারা কলম উৎপাদন-আমদানি করা হবে। এছাড়া ৩০২টি কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে পিএসআইসহ ৯৩টি পাওয়ার টিলার, ৭০টি পাওয়ার টিলার অপারেটিভ অনিয়ন প্লান্টার, ৭৫টি পাওয়ার টিলার অপারেটিভ গারলিক প্লান্টার অপারেটিভ কেনা হবে।

এছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় ২৫টি দারুচিনি শুকানোর যন্ত্র ও ৩৯টি মরিচ শুকানোর যন্ত্র কেনা হবে। সেই সঙ্গে প্রকল্প এলাকায় সীমানা প্রাচীর এবং বিভিন্ন শেড নির্মাণের কাজ রয়েছে। ২ হাজার ৬৫০ ব্যাচ কৃষকের প্রশিক্ষণ, ৪৫ ব্যাচ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, দুই ব্যাচ বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, ১৩৫ ব্যাচ কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ এবং ১ হাজার ৬৫০টি কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনাও করা হবে এই প্রকল্পের অধীনে।

প্রকল্পের আওতাভুক্ত জেলাগুলো হচ্ছে— ঢাকা বিভাগের ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলা; ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা; রাজশাহী বিভাগের নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওঁগা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলা; খুলনা বিভাগের যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, মাগুড়া ও ঝিনাইদহ জেলা; চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলা; রংপুর বিভাগের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও দিনাজপুর জেলা; এবং সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা। অনুমোদন পেলে এসব জেলার ১১০টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

এসএইচ-২২/২৭/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সারাবাংলা)