সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য মোটরসাইকেলের দিকে আঙ্গুল

দেশের পদ্মা সেতুতে প্রথমদিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর পর সেতুতে এই বাহনটির চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মোটর চালকদের সেতু পারাপার করার নানা কৌশল নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই আলোচনা চলছে।

কর্মকর্তাদের দাবি মোটর চালকদের বিশৃঙ্খলা তৈরি এবং বেপরোয়া চলাচল এড়াতে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বুধবার সকালেও ঢাকা ও রাজবাড়ীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে দুইজন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।

আর বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার ৩৯ শতাংশই মোটরসাইকেলের কারণে হয়েছে।

এর পেছনে অবৈধভাবে লাইসেন্স পাওয়া, লাইসেন্স ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া চালানো আর ঝূঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালানোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজবাড়ীর একটি কলেজের ছাত্র লিমনের (ছদ্মনাম) দাবির মুখে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগেই পরিবার মোটরসাইকেল কিনে দিতে বাধ্য হয়। না হলে সে পরীক্ষায় না বসার হুমকি দিয়েছিল।

কিন্তু পরীক্ষার মাত্র দুইদিন আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার পা ভেঙ্গে যায়। শেষ পর্যন্ত তার আর পরীক্ষায় বসা হয়নি।

দুর্ঘটনায় লিমন বেঁচে গেলে, বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ২ হাজার ৭৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জনের।

দুই হাজার কুড়ি সালের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশ। নিহতদের বেশিরভাগের বয়স ৩০ বছরের নীচে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়, এমন ১৬টি দেশের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলছেন, ”দেশে মোটরসাইকেলের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। কম টাকায় মোটরসাইকেল কিনতে পাওয়া যায়, লোনে ও কিস্তিতে পাওয়া যায়। মানুষ সামান্য টাকা হলেই এটা কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃত্যু ঝুঁকি কতো বাড়ছে, সেটা কেউ চিন্তা করছে না। ”

বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে সংযোজনের কারণে মোটরসাইকেলের দাম অনেক কমে এসেছে। নিবন্ধন প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। ফলে এখন দুই বছরের নিবন্ধন ফি জমা দিয়ে মোটরসাইকেল রাস্তায় নামানো যায়।

অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন,”এদের বেশিরভাগই কিশোর-তরুণ। তারা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালায়, হেলমেট পড়ে না, রাস্তার কোন আইন মানে না। ফলে এরা নিজেরাও দুর্ঘটনায় পড়ে, অন্য যানবাহনের জন্যও বিপদ তৈরি করে।”

পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের মতো মি. তালুকদারও মনে করছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনার পেছনে মোটরসাইকেল চালকদের বড় দায় রয়েছে।

তিনি বলছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করছে মহাসড়কগুলোয় মোটরসাইকেল চালানো।

ঈদুল ফিতরের সময় মহাসড়কগুলোতে মোটরসাইকেলে আধিক্য বেড়ে গিয়েছিল।

সেই সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।

ফলে ১৯শে জুন বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে ডিভিশনের একটি আলোচনায় ঈদুল আযহার সময় মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা নিয়ে কথা হয়।

”মোটরসাইকেল একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন, এটা হাইওয়েতে চালানোর মতো গাড়ি না। সেখানে বিশেষ লেন থাকলে চালানো যেত, কিন্তু বাস-ট্রাকের পাশাপাশি হাইওয়ে মোটরসাইকেল চলা উচিত নয়, ” তিনি বলছেন।

অভিযোগ রয়েছে, মোটরসাইকেল চালকদের বড় একটি অংশের লাইসেন্স নেই। যাদের রয়েছে, তাদের অনেকে সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়াই লাইসেন্স পেয়েছেন।

বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। কিন্তু মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স রয়েছে ২৩ লাখের মতো। অর্থাৎ ১৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।

তবে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ১৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল রয়েছে, যেগুলোর এমনকি নিবন্ধনও নেই।

বাংলাদেশের একাধিক জেলা-উপজেলা যাত্রী বহনকারী অনেক মোটরসাইকেলেরই নিবন্ধন, চালকদের লাইসেন্স নেই বলে দেখতে পেয়েছি আমি।

বরগুনার এরকম একজন মোটরসাইকেল চালক বলেছেন, তিনি ভাড়ায় গাড়ি চালান। প্রতি মাসে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে ৩০০ টাকা দেন। ফলে ওই এলাকার পুলিশ তার গাড়ি ধরে না।

নিয়ম অনুযায়ী, যথাযথভাবে আবেদনের পর নির্দিষ্ট দিনে সশরীরে পরীক্ষা দিয়ে ও গাড়ি চালিয়ে দেখিয়ে লাইসেন্স পেতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ঘিরে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকার একজন মোটরসাইকেল চালক বলেছেন, তিনি আট হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স করেছেন। কিন্তু তার এমনি পরীক্ষা দিতেও যেতে হয়নি। শুধু একদিন গিয়ে কয়েকটি স্বাক্ষর করতে হয়েছে। তাতেই তিনি লাইসেন্স পেয়ে গেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সের যে পরীক্ষা নিয়ে থাকে, সেখানে চালকের দক্ষতার বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই করা হয় না।

অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলছেন, অনেকে লাইসেন্সের তোয়াক্কাই করে না। কারণ লাইসেন্স না থাকার পরেও তার তেমন সমস্যা হয়না, না হলে টাকা পয়সা দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে ম্যানেজ করে ফেলে। আবার লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়াতেও যে সমস্যা আছে, সেটাও তো আমরা জানি।”

তবে লাইসেন্স প্রক্রিয়া অনিয়ম নিয়ে দায় নিতে রাজি নয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

বিআরটিএ মুখপাত্র মাহবুব-ই-রব্বানি বলছেন, ”যদিও লাইসেন্স আমাদের মাধ্যমে যাচ্ছে, কিন্তু এই লাইসেন্সের পরীক্ষা আমরা নেই না। আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি, বোর্ড গঠন করেছে। জেলা প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক ও রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হয়। বিআরটিএ শুধুমাত্র লাইসেন্সটা দেয়। দেয়া হয়। এর বাইরে আমাদের পক্ষ থেকে আর কী করার আছে?”

পরীক্ষা নিয়ে এই কমিটি যাদের অনুকূলে সুপারিশ করে, তাদেরকেই শুধুমাত্র লাইসেন্স দেয়া হয় বলে তিনি বলছেন। এক্ষেত্রে বিআরটিএ কোন অনিয়ম করে না বলে তিনি দাবি করেন।

অভিযোগ রয়েছে, মোটরসাইকেল চালক বা যাত্রীদের অনেকেই হেলমেট পড়তে চান না। কয়েক বছর হেলমেট না থাকলে পাম্পে তেল না দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল মহানগর পুলিশ। তারপরে হেলমেট ছাড়া অনেক চালক বা যাত্রীদের দেখা যায়।

সেই সঙ্গে মোটরসাইকেলে সর্বোচ্চ দুইজন চড়ার কথা থাকলেও তিনজন নিয়ে চালানো অনেকটাই নিয়মিত ঘটনা। আবার দূরপাল্লায় মোটরসাইকেল ব্যবহার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

মঈনুল ইসলাম নামের একজন মোটরসাইকেল চালক বলছেন, ”ঢাকায় যে যানজট, তাতে মোটরসাইকেলে সহজে যেকোনো গন্তব্যে যাওয়া যায়। সময় বাঁচে, খরচও বাঁচে।”

গত ঈদুল আযহার সময় তিনি স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গেছেন মোটরসাইকেলে করে।

”ঈদের সময় বাসের টিকেট পাওয়া যায় না, তিনগুণ চারগুণ দাম চাওয়া হয়। তারচেয়ে সাবধানে চালিয়ে বাড়িতে গেছি, আসছি।” তিনি বলছেন।

তবে বিআরটিএ বলছে, আইনে বাধা না থাকলেও মহাসড়ক বা দূরপাল্লার জন্য মোটরসাইকেল অনিরাপদ একটি বাহন। নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে চালকদের নিজেদেরই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।

বিআরটিএ রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানি বলছেন, ”মোটরসাইকেল তো একটা বৈধ বাহন, তবে এটা তো ঠিক যে, মোটরসাইকেল অন্যান্য গাড়ির তুলনায় অনিরাপদ বাহন। নিজস্ব প্রয়োজনে স্বল্প দূরত্বের এটা ব্যবহার করার কথা। কিন্তু সেটার মিসইউজ করা হচ্ছে। লং ডিসট্যান্সে যাচ্ছে। লং ডিসট্যান্সে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল তো না। রাইডাররা নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে।”

আর পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”ঢাকা এবং সারাদেশেই অবৈধ মোটরসাইকেল, লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে পুলিশ নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়ে আসছে। প্রতিদিনই এরকম চালকদের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়, মোটরসাইকেল আটক করা হয়। সুতরাং এখানে পুলিশের দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ সঠিক নয়।”

”যেসব অনিয়মের কথা বলছেন, পুলিশের কারও বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ পেলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সাসপেন্ড করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও সব জেলার এসপি, ওসিদের এসব ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া আছে, হেডকোয়ার্টার থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। দুর্নীতি অনিয়মের ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীতে টলারেন্সের কোন সুযোগ নেই,” তিনি বলছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে যেভাবে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত না হলে এরকম দুর্ঘটনা বন্ধ করা কঠিন।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলছেন, ”মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলতে না দেয়া, সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লাইসেন্স দেয়া, প্রয়োজন যাচাই করে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেয়া- নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এখন তো বরং মোটরসাইকেল সবার জন্য সহজলভ্য করে তোলা হয়েছে। সেখানে পরিবর্তন আনা না গেলে এভাবে বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু, হতাহত হওয়া বন্ধ হবে না।”

এসএইচ-২৬/২৯/২২ (সায়েদুল ইসলাম, বিবিসি)