ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে লাঠিচার্জ নিয়ে পুলিশ সমালোচিত হচ্ছে!

দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বরগুনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পুলিশের লাঠিচার্জ আর স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে অসদাচরণের অভিযোগ নিয়ে সরকার এবং সরকারী দলের মধ্যে সমালোচনা চলছেই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাটিতে বাড়াবাড়ি হয়েছে উল্লেখ করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে বরগুনা থেকে চট্টগ্রাম রেঞ্জে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

অথচ এ ঘটনার মাত্র পনের দিন আগে দক্ষিণাঞ্চলের আরেক জেলা ভোলায় একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত (একজন ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আর অন্যজন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান) হওয়ার ঘটনাতেও পুলিশের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

এ দুটি মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিরোধী দল প্রশ্ন তুললেও সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কোন পর্যায় থেকে কোন সমালোচনা তো নয়ই, বরং পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এ ঘটনার জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই উচ্ছৃঙ্খল আচরণের অভিযোগ করেছিলেন।

দেশের বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠকরা বরাবরই রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা দেয়া, লাঠিচার্জ করা কিংবা নির্দয় দমন-পীড়নের অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের দিক থেকে বরগুনার ঘটনার পর পুলিশের বিরুদ্ধে এমন সমালোচনাকে বিরল বলছেন মানবাধিকার সংগঠক, নূর খান লিটন।

“এখন সমালোচনা করছেন সরকারি দলের সমর্থকরাই। তারাই সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল তুলেছেন কারণ তাদের ধারণাই হলো পুলিশ মারবে বিরোধীদের আর ক্ষমতাসীনদের অংশ হয়ে কাজ করবে। হুট করে সেটার ব্যত্যয় হওয়ায় তারা মেনে নিতে পারছে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন সাংবাদিক বলছিলেন যে বরগুনায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। ছাত্রলীগের সম্প্রতি হওয়া কমিটিকে গ্রহণ করেনি স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী লীগের একাংশ।

এসব নিয়েই কোন্দল ছিলো চরমে যার বহি:প্রকাশ হয়েছে পনেরই অগাস্ট শোক দিবসের অনুষ্ঠানে। ওই অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের দু পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে এক পর্যায়ে নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। লাঠিচার্জের বেশ কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায় ইউনিফর্ম ছাড়া একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশ সদস্যেরা সামনে যাকে পাচ্ছেন তাকেই বেধড়ক মারছেন।

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তার সামনেই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছিলো।

পরে পুলিশের লাঠিচার্জ আর একজন পুলিশ কর্মকর্তা মিস্টার শম্ভুর সামনে কথা বলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আসলে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু করেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। পরে দেশজুড়ে তাদের অনুসারীরা ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন।

যদিও ঘটনার পর স্থানীয় ছাত্রলীগ সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের পক্ষেই বক্তব্য দিয়েছিলো।

তবে ওই ঘটনায় বাড়াবাড়ি ছিলো বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে তিনি বলেছেন তদন্ত হলেই বোঝা যাবে কারা বাড়াবাড়ি করেছে। বিষয়টি নিয়ে এখন তদন্ত করছে পুলিশ।

ঢাকাসহ সারাদেশেই গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচিতে পুলিশের দিক থেকে বাধা বা লাঠিচার্জ হয়নি এমন উদাহরণ খুবই কম।

বরং বিরোধী দলের কর্মসূচি থেকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা একের পর এক নেতা কর্মীকে আটক করে পুলিশের গাড়িতে তোলার দৃশ্যও নিয়মিত দেখা যায়।

প্রায় এক দশক আগে বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্যকে সংসদ ভবন এলাকাতেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নির্বিচারে মারধর করার ঘটনাও বেশ আলোচিত হয়েছিল।

ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতেও পুলিশের আচরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো।

গত ১৪ই মে মাগুরায় প্রায় ৭০টি মাইক ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সম্মেলন করলেও ঠিক তার পরদিন সেখানে বিএনপির সমাবেশ পুলিশ পণ্ড করে দিয়েছিলো বিনা অনুমতিতে মাইক ব্যবহারের অভিযোগে।

কিন্তু এমন অনেক ঘটনার পরেও রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের আচরণ বা ভূমিকা নিয়ে সরকারি দলের কেউ কখনো প্রশ্ন তুলেনি।

তাহলে এবার কেন বরগুনার পুলিশ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের সাবেক ডিআইজি মোখেলসুর রহমান বলছেন বরগুনার ঘটনাটি শুধু লাঠিচার্জের কারণে এতো আলোচনায় আসতো না বলেই মনে করেন তিনি।

“সংঘর্ষ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অ্যাকশনে যাওয়া পুলিশের জন্য আইনসংগত। কিন্তু দিনটি ছিলো পনেরই অগাস্ট এবং সেখানে একজন এমপি ছিলেন। তার সাথে একজন জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তারা কথা কাটাকাটির কারণেই আলোচনায় এসেছে বিষয়টি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রহমান বলেন যে পুলিশ কোন কর্মসূচিতে বাধা দিলে যারা খুশি হতো এখন তাদের ওপরই অ্যাকশন হওয়াতে তারা সমালোচনা করছে এবং সে কারণেই পুলিশকে দোষ দেয়া হচ্ছে।

বরিশালে পুলিশের নির্যাতনে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ

চলচ্চিত্রের দৃশ্যে পুলিশকে হেয় করার অভিযোগ, পরিচালক ও অভিনেতা গ্রেপ্তার

তার সঙ্গে একমত মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন। তিনি বলছেন যে এখন সাধারণ মানুষের ধারণাই হয়ে গেছে যে পুলিশ বিরোধী দলের সভা সমাবেশ ভণ্ডুল করবে বা তাদের নেতাকর্মীদের মারবে-ধরবে।

কিন্তু সরকারি দলের কর্মীদের এভাবে লাঠিচার্জ করা হবে কিংবা পুলিশের গাড়ি ভাংচুরের জন্য তাদের পুলিশ শাসাবে এটি ছিলো অকল্পনীয়।

“এখানে পুলিশের বৈশিষ্ট্যই হলো যে পুলিশ সরকারি দলকে খুশি রাখতে কাজ করে। সরকারি দলের লোকজনও সবসময় মনে করে যে পুলিশের টার্গেট হবে বিরোধী দল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তারা একে অপরের সহযোগী হয়ে কাজ করে। কিন্তু বরগুনায় এমপির সামনে তারা ব্যাপকভাবে ছাত্রলীগকে আক্রমণ করেছে। এমপিকে শাসিয়েছে। এটি তাদের বিস্মিত করেছে। এ কারণেই সামাজিক মাধ্যমে তারা ঝড় তুলেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিস্টার খান।

পুলিশ কর্মকর্তারা তদন্ত চলার কথা উল্লেখ করে এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন যে অনেক জায়গাতেই ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার বিরোধের কারণে পুলিশ ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। সে কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবেই সরকারি দলের নেতাদের সহযোগিতা নিতে হয়।

তবে বরগুনায় একজন কর্মকর্তার আচরণে দায়িত্বশীলতার অভাব ছিলো নাকি সেটি সেখানকার ঘটনার একটি তাৎক্ষনিক রিয়েকশন সেটি তদন্ত হলেই বোঝা যাবে বলে মনে করেন তিনি।

এসএইচ-০১/১৮/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)