ভারতের সাথে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যে আগ্রহী বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা!

ভারতের বৃহত্তম ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রূপি ও টাকায় লেনদেন সম্পন্ন করার যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটাকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

গত মাসে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তাদের অধীনে থাকা শাখা ব্যাংকগুলোকে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের এই নির্দেশনা দেয়।

ডলারের দাম ওঠানামা করায় দুই দেশের বাণিজ্যে গতি আনতে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন উভয় দেশের জন্যই সুবিধাজনক হবে বলে বলছেন তারা।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে যেহেতু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা আসেনি তাই এ বিষয়ে তারা এখনও কিছু ভাবছেন না।

বিশেষজ্ঞদের দাবি বলছে, দুই দেশের বাণিজ্যে বাংলাদেশ যেখানে ঘাটতিতে আছে সেখানে রুপি -টাকায় লেনদেন বাংলাদেশকে আরও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

চলতি বছর বিশ্বজুড়ে ডলারের দর ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় দুই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে।

এমন অবস্থায় শতভাগ না হলেও ভারতের সাথে বাণিজ্যের আংশিক রূপি-টাকায় লেনদেন করা হলে দুই দেশই সুবিধা পাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা।

“ডলারের দাম ক্রমাগত ওঠানামা করছে। দামের এই ওঠানামার কারণে বেশিরভাগ সময় আমরা লোকসানের মুখে পড়ি,” বলছেন ভারত বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি মাতলুব আহমদ ।

”কিন্তু বাণিজ্যের কিছু অংশ ভারতীয় রূপিতে লেনদেন করলে খরচের হিসাবটা ঠিক থাকবে। সেইসাথে ডলার ছাড়া ব্যবসার কারণে রিজার্ভে ডলারের ওপর চাপ কমবে। এদিকে উভয়পক্ষেরই সুবিধা,” তিনি বলেন।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।

বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা প্রায় ২শ কোটি ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করে। তার বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলারের পণ্য।

অর্থাৎ ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের মতো।

দু দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ যেহেতু কম, তাই রুপি ও টাকার লেনদেনে ভারত লাভবান হলেও বাংলাদেশ চাপে থাকবেন বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ যদি ভারতের সাথে রূপি-টাকায় লেনদেনে যায়, তাহলে সেটা একপক্ষীয় মুদ্রা বা রূপি-ভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় উপনীত হতে পারে এবং বাংলাদেশের ওপর অধিক হারে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের চাপ তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

উদাহরণ হিসেবে তারা নেপাল ভারত বাণিজ্য প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।

তাছাড়া এই বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক লেনদেনের মতো যথেষ্ট রূপির রিজার্ভ বাংলাদেশের আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে ব্যাংকগুলো।

এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, ডলার সংকটের কারণে সবাই বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের কথা ভাবছে।

”এখন ভারতের ওই ব্যাংক যে রূপিতে বাণিজ্যের কথা বলছে, আমাদের তো সে পরিমাণ রূপির রিজার্ভ নাই। তাছাড়া বাংলাদেশ আমদানি করে বেশি, রপ্তানি করছে কম। এই যে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে সেটার লেনদেন তো রূপিতে সম্ভব না,” তিনি বলেন।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ওই সিদ্ধান্তটি যেহেতু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে নয় বরং রিজার্ভ ব্যাংকের অধীনে থাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে এসেছে, সেজন্য তাদের এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছু নেই।

“এটা যেহেতু রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ব্যাপার না। একটিমাত্র ব্যাংকের ব্যাপার,” বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন।

”তাদের ওই ব্যাংকের নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সুতরাং এ ব্যাপারে আমরা এখনও চিন্তা করিনি,” তিনি বলেন।

ডলারের মতো রূপি-টাকার আন্তর্জাতিক মানও ওঠানামা করে। এটাও স্থিতিশীল নয়।

এ কারণে ব্যাংকের জন্য এই লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ হবে এবং ব্যাংক এই ঝুঁকির কারণে বাড়তি চার্জ রাখতে পারে।

তাই এই দুই দেশের বড় আকারে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যে যাওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

“ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে ভারত বাংলাদেশ উভয়ই ভুগছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না,” মি. মোয়াজ্জেম বলেন।

তার আশঙ্কা, যদি রুপি-টাকায় লেনদেন একবার শুরু হয় তাহলে এটি শুধুমাত্র স্থানীয় পণ্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বিভিন্ন সেবামূলক বাণিজ্য যেমন ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়বে, যা বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৩৭০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, এক বছর আগে ৪৮০০ কোটি ডলার ছিল। এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের ফলে সেটার ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

কারণ আইএমএফের সদস্য দেশগুলো সহজ ও নিরাপদ লেনদেনের জন্য কেবল পাঁচটি মুদ্রাকে স্বীকৃত দিয়েছে। সেগুলো হল ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও পাউন্ড।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য রুপি টাকায় লেনদেনে যাওয়া ঝুঁকির সৃষ্টি করবে বলে তিনি মনে করছেন।

“আইএমএফ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। সেক্ষেত্রে বিকল্প মুদ্রা যদি রিজার্ভে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে তাহলে সেটা ঋণ সংক্রান্ত আলোচনাতেও প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে ঋণ দেয়া বা সুদের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে,” মি. মোয়াজ্জেম বলেন।

মোয়াজ্জেম পরামর্শ দিয়েছেন, সরকারের সর্বতোভাবে চেষ্টা করা দরকার ডলারের মাধ্যমে বিনিময় টিকিয়ে রাখা। ভারতীয় মুদ্রাকে কম ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে দুই দেশের উচিত হবে ডলারের ব্যবহার কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে ভাবা।

তিনি এটাও বলেছেন যে বাংলাদেশের এখন যে অবস্থায় রয়েছে সেক্ষেত্রে সীমিত আকারে লেনদেন হতে পারে বা বাংলাদেশ পরীক্ষামূলকভাবে রুপি-টাকায় বাণিজ্য করে দেখতে পারে। সেক্ষেত্রে ফলাফল কি হল সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তবে মুদ্রার দরে ওঠানামা থাকায় আমদানিকারণ রপ্তানিকারক কতোটা বাণিজ্য করতে চাইবেন, ব্যাংকগুলো এই ঝুঁকি কতোটা নিতে চাইবে, সেটাও দেখার বিষয়।

সম্প্রতি চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে টাকা-রুবলে লেনদেনেরও আলোচনা চলছে। এখন রূপির বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসে কি না সেটাই দেখার বিষয়।

এসএইচ-০১/২৩/২২ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)