গুম তালিকায় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ে প্রশ্ন-পাল্টা প্রশ্ন

বাংলাদেশ থেকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের যে তালিকা গত বছর জাতিসংঘ প্রকাশ করেছে তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে৷

বিশ্লেষকরা নানা ধরনের মত দিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷

সজীব ওয়াজেদ জয় এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশে ‘জোর করে গুমের’ শিকার ৭৬ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ৷ কিন্তু এই তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির গ্রহণযোগ্যতাকে৷’’ তার কথা, ‘‘তালিকায় থাকা ৭৬ জনের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশে বসবাস করছে, যার প্রমাণ মিলেছে৷ সেখানে দু’জন ভারতীয় নাগরিকের নাম আছে৷ আবার অনেক তালিকাভুক্ত পলাতক আসামির নাম রয়েছে এখানে৷ যার কারণে যেই এনজিওগুলোর ওপর নির্ভর করে জাতিসংঘের প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, সেই এনজিওসহ প্রশ্ন উঠছে খোদ জাতিসংঘের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘তালিকায় দুই জন ভারতের মনিপুর রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী, নিষিদ্ধ সংগঠন ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট-ইউএনএলফ এর শীর্ষ নেতা৷ একজন সংগঠনটির চেয়ারম্যান, অপরজন মেজর পদমর্যাদার৷ তারা হলেন- সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘান ও কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র ওরফে শিলহেইবা৷’’

তার প্রশ্ন এবং উত্তর, ‘‘জাতিসংঘের একটি গ্রুপ কীভাবে এত বড় ভুল করতে পারে? উত্তরটি সহজ- তারা শুধুমাত্র স্থানীয় বাংলাদেশভিত্তিক এনজিওদের দ্বারা সরবরাহকৃত গুমের ঘটনাবলীকে তথ্য যাচাই না করেই প্রকাশ করেছে৷’’

জাতিসংঘ গত বছর বাংলাদেশ থেকে গুম হওয়া ৭৬ জনের তালিকা প্রকাশ করে৷ সরকার জানায়, তাদের মধ্যে ১০ জন ফিরে এসেছেন, বাকিদের কোনো খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি৷

সংবাদমাধ্যম বলছে, তালিকার একজন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউএনএলএফ-এর শীর্ষ নেতা সাইআমা রাজকুমার ওরফে মেঘানকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ তুলে নেয় বলে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর বলছে, তাকে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ভারতে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ভারতের আদালতের দেয়া ১০ বছর কারাভোগের পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতের গুয়াহাটি কারাগার থেকে মুক্তি পান৷

আরেকজন ইউএনএলএফ নেতা ইথেল্লাকপাম নবচন্দ্রকে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রæরি বাংলাদেশে সাদা পোশাকে পুলিশ নিয়ে যায় বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়৷ তবে ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, তাকে ভারতীয় সীমান্ত শহর মেঘালয়ের ডাউকি থেকে আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ৷

জাতিসংঘের গুমের তালিকায় আছেন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত ও সাজাপ্রাপ্ত হাসিনুর৷ শৃঙ্খলাভঙ্গ ও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে৷ তিনি এক বছর ছয় মাস নিখোঁজ থাকার পর দুই বছর ছয়মাস আগে বাড়ি ফিরে আসেন৷

বাংলাদেশে যেসব মানবাধিকার সংগঠন গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা করে, তাদের মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) অন্যতম৷ আসকের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আমরা যে তালিকা সংরক্ষণ ও প্রকাশ করি তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়৷ আমরা সেটা বলেও দিই৷ আমাদের পক্ষে সবগুলো ঘটনার অনুসন্ধান সম্ভব হয় না৷ তবে আমরা কিছু কিছু ঘটনার অনুসন্ধান করি৷ যদি ৫০০ ঘটনা পাওয়া যায়, তার ২৫টি অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়৷’’

তবে তিনি দাবি করেন, ‘‘জাতিসংঘের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই, কারণ, তারা কোথা থেকে তালিকা পেয়েছে বা কীভাবে সংগ্রহ করেছে সেটা মূখ্য নয়, তারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করেই প্রকাশ করেছে৷ যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কথা বলা হচ্ছে, আমার জানা মতে তাদের একজন দিল্লি হাইকোর্টে রিট আকারে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল তাদের ঢাকা থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে৷ ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় তার আত্মীয়-স্বজনের করা একটি জিডির কপিও আমরা তখন দেখেছি৷ পরবর্তীতে তাকে যখন বিহারে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়, তখন তার পরিবারের লোকজন বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছিল৷

আরেকজনের বিষয়টি আমার জানা নেই৷ তবে এই ধরনের ঘটনা তো ঘটছে৷ বাংলাদেশ থেকে উঠিয়ে নিয়ে ওখানে গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা তো আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি৷ আর হাসিনুরের বক্তব্য এবং তার পরিবারের কথা তো আমরা এরই মধ্যে শুনেছি৷ তাতে স্পষ্ট যে, প্রথম দফায় যখন তুলে নেয়া হয়, তখন সেটা ছিল গুম৷ দীর্ঘ সময় পরে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে৷’’

নুর খান বলেন, ‘‘জাতিসংঘকে বাংলাদেশের কোনো মানবাধিকার সংগঠন তথ্য দেয় বলে আমার জানা নেই৷ তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করে৷’’

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট গত আগস্টে যখন ঢাকা সফর করেন, তখন গুম নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন৷ সেখানেও নূর খান ছিলেন৷ নূর খান বলেন, ‘‘সেখানে নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লোকজন ছিলেন৷ ওই বৈঠক শুধু গুম নিয়ে নয়, সার্বিক মানবাধিকার নিয়ে ছিল৷ জাতিসংঘ তো গুমের বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত চেয়েছে৷ আমরাও সেটা চেয়ে আসছি৷ সেটা করলেই সব কিছু স্পষ্ট হবে৷’’

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘গুমের ঘটনা ঘটে এবং ঘটে থাকে৷ এর বিরুদ্ধে আমরা মানবাধিকার কর্মীরা সব সময়ই সোচ্চার৷ কিন্তু জাতিসংঘ একটি সার্বজনীন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান৷ আমরা তাদের দেয়া তথ্য নির্ভুল এবং যাচাই-বাছাই করা বলে ধরে নিই৷ কিন্তু সেই জাতিসংঘ যখন বিদেশি নাগরিক, যারা সেই দেশে গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের বাংলাদেশের গুমের তালিকায় দেখায়, তখন তাদের শুধু গ্রহণযোগ্যতা নয়, তারা মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ড কতটা নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করে আর কতটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, সেই প্রশ্নও দেখা দেয়৷’’

তিনি মনে করেন, ‘‘জাতিসংঘ নানাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে৷ তারা যদি স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে থাকে, তাহলে যারা তথ্য দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে এখন সরকারেরও খতিয়ে দেখার দায়িত্ব আছে৷ আর যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্য প্রকাশ তো তারা করতে পারে না৷ ভুল বা মিথ্যা তথ্য দেয়া জাতিসংঘের মাবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী৷ তারা এটা করে একটা রাষ্ট্রকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে৷’’

তার কথা, ‘‘এখন বাংলাদেশ যদি বলে এই ভুল তথ্যের তালিকা আমরা বিবেচনায় নেবো না বা এটা নিয়ে কোনো তথ্য দেবো না, তাহলে সেটা রাষ্ট্র করতে পারে৷ সেটা সরকার বা রাষ্ট্রের বিষয়৷’’

তাতে পুরো তালিকা অগ্রহণযোগ্য হয় কিনা- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো বলেছি এখানে গুম হয়৷ কিন্তু সেটা নিয়ে জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান ভুল তথ্য দিলে সরকার সেই তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে৷’’

আর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক হুমায়ুন কবির মনে করেন, ‘‘এ ধরনের তালিকা করার সময় আরো যত্নশীল হওয়া দরকার৷ তবে ভারতীয় নাগরিক তালিকায় থাকতে পারবে না এটা তো কোনো কথা নয়৷ নাম একটা আসলো, যাচাই বাছাই করে দেখা গেল সে ভারতীয় লোক৷ এরকম হতে পারে৷’’

তার কথা, ‘‘সরকার বলতেই পারে তালিকায় ভুল আছে৷ ভুল থাকলে সেটা তারা শুদ্ধ করে নেবে৷ তাই বলে পুরো তালিকা ভুল বা প্রশ্নবিদ্ধ সেটা বলা ঠিক হবে না৷’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এটা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হওয়া দরকার৷ যারা তালিকা করেন, তাদের যেমন বস্তুনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন, সকারেরও তেমনি অভিযোগ তদন্ত করে দেখা উচিত৷’’

এসএইচ-০২/২৪/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)