বৃদ্ধ বয়সের জন্য কতটা প্রস্তুত দেশের তরুণ প্রজন্ম

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন ৪০ বছরের মিজানুর রহমান। সাংসারিক খরচেই বেতন ভাতার সবটা খরচ হয়ে যায়।

গত ১৫ বছর ধরে চাকরি করলেও তার তেমন কোন সঞ্চয় নেই।

বয়স বাড়লে নানা রোগব্যাধি দেয়া দেয়, একটা সময়ে অবসরও নিতে হবে; তখনকার জন্য কিছু কী ভেবেছেন? মি. রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম।

মিজানুর রহমান স্বীকার করলেন, বৃদ্ধ বয়সের কথা তেমন গুরুত্ব দিয়ে আসলেই ভাবা হয়নি। আর যেভাবে সব খরচ বাড়ছে, সেখান থেকে আলাদা সঞ্চয় করাটাও তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

”একটা ডিপিএস করেছিলাম। মায়ের অসুস্থতার সময় সেটা ভেঙ্গে চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু নিজের বৃদ্ধ বয়সের জন্য আসলেই এখনো কিছু পরিকল্পনা করে উঠতে পারিনি,” তিনি বলছেন।

ষাট বছরের বেশী বয়সী মানুষকে বাংলাদেশে প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে, বর্তমানে দেশে প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ প্রবীণ নাগরিক রয়েছেন। ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৮০ লাখে আর ২০৫০ সাল নাগাদ হবে প্রায় সাড়ে চার কোটি।

বাংলাদেশে প্রবীণদের নিরাপত্তা দেয়ায় সরকার বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট ৫৭ লাখ প্রবীণ নাগরিক বার্ধক্য ভাতা পাচ্ছেন, যদিও সেই টাকার পরিমাণ খুই কম।

সামাজিকভাবে বাংলাদেশে একসময় প্রবীণরা পরিবারের প্রধান সদস্য হিসাবে মর্যাদা পেয়ে আসতেন। কিন্তু এখন অনেক স্থানে সেই পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন ২০৩৫-৩৭ সাল সময়ের পর থেকেই মূলত তরুণদের তুলনায় ক্রমশ বয়স্কদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে এবং ২০৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরিণত হবে বয়স্কদের সমাজে।

“একদিকে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। আবার অন্যদিকে প্রজনন হার কমছে। সে কারণেই বয়স কাঠামোর মধ্যে একটা পর্যায়ে গিয়ে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়বে। যে অভিজ্ঞতা জাপানের হয়েছে। এখন চীনের হচ্ছে। সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশকেও হতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

কিন্তু নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বয়স্কদের মধ্যে একাকীত্ব যেমন বাড়ছে তেমনি অনেকের জন্য তৈরি হচ্ছে অসহায়ত্বও।

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলছেন, গ্রাম থেকে চাকুরী ও শিক্ষার প্রয়োজনে এখন বহু মানুষ শহরে এমনকি দেশের বাইরেও যাচ্ছে।

আবার গ্রামেও যৌথ পরিবার কমে যাচ্ছে ফলে সেখানেও অনেক বৃদ্ধ দম্পতি বা প্রবীণরা সংকটে পড়ছেন।

ফলে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ ও পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ নামে আইনও অনুমোদন করেছে। সেখানে প্রবীণদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও অধিকরা রক্ষায় নানা বিধান করা হয়েছে, যদিও সেসব বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস, যেখানে প্রতিপাদ্য ‘পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা।’ ১৯৯০ সাল থেকে দিনটিকে প্রবীণদের সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে পালিত হয়ে আসছে।

কিন্তু বাংলাদেশে যারা প্রবীণদের নিয়ে কাজ করেন, তারা বলছেন, বাংলাদেশ এখনো প্রবীণ বান্ধব নয়। সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে তাদের প্রাপ্য অধিকার তাদের দেয়া হচ্ছে না।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী সিদরাতুল মুনতাহা বহু বছর ধরে বেতনের একটি অংশ ডিপিএস আকারে জমিয়ে যাচ্ছেন। এখানে টাকা জমিয়ে তিনি বেশ কয়েক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও কিনেছেন।

তিনি বলছিলেন, ”ঠিক শেষ বয়সের কথা ভেবে নয়, বিপদ-আপদের কথা ভেবে কিছু টাকা জমিয়েছি। কোন সমস্যায় পড়লে কাজে লাগবে। আর জমে থাকলে হয়তো জমি কেনা বা কোন কাজে লাগানো যাবে।”

তিনি টাকা-পয়সা জমালেও বৃদ্ধ বয়সের কথা সেভাবে ভাবেননি। পর্যাপ্ত টাকা জমলে তিনি জমি বা ফ্ল্যাট কিনতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলছেন ২০৩৫-৩৭ সাল সময়ের পর থেকেই মূলত তরুণদের তুলনায় ক্রমশ বয়স্কদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে এবং ২০৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরিণত হবে বয়স্কদের সোসাইটিতে।

“একদিকে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। আবার অন্যদিকে প্রজনন হার কমছে। সে কারণেই বয়স কাঠামোর মধ্যে একটা পর্যায়ে গিয়ে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়বে। যে অভিজ্ঞতা জাপানের হয়েছে। এখন চীনের হচ্ছে। সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশকেও হতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

চার ছেলেমেয়ের মা আনোয়ারা (আসল নাম নয়) আলাদা করে কখনো কিছু জমাতে পারেননি। এখন তার বয়স ৭০ বছর। তার চার ছেলেমেয়ের সঙ্গে পালা করে থাকেন।

তিনি আমাকে বলছিলেন, যখন বয়স কম ছিল, তখন এই বয়সের কথা চিন্তা করে আলাদা কোন সঞ্চয় করেননি। কিন্তু সেটা করলে আজ হয়তো ছেলেমেয়ের সংসারে তার গুরুত্ব আরেকটু বেশি হতো।

তবে আবু আহমেদ বৃদ্ধ বয়সের কথা ভেবেই সঞ্চয় করছেন।

”আমার বাবা যখন বৃদ্ধ বয়সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, হাতে নগদ টাকার অভাবে ঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি। বুড়ো বয়সে তো নানারকম রোগব্যাধি হবে। সেটার জন্যই আলাদা করে কিছু টাকা জমিয়ে রাখছি,” তিনি বলছেন।

বাংলাদেশে যারা প্রবীণদের নিয়ে কাজ করেন, তারা বলছেন, আজকের নবীনদের মধ্যে তাদের বৃদ্ধ বয়স নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনার প্রবণতা এখনো তৈরি হয়নি।

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সাবেক মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.এএসএম আতিকুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”গত ৪০ বছর ধরে আমি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করছি, কিন্তু দুঃখজনক হলো, বার্ধক্য যে আসছে, সেজন্য প্রস্তুতির দরকার আছে, সেটা নিয়ে কাউকে সচেতন হতে দেখিনি।”

সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হবে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা আর থাকার ব্যবস্থা নিয়ে। বিশেষ করে যাদের সন্তান নেই, তাদের বিষয়টি আরও ঝুঁকি তৈরি করবে। সেজন্য একদিকে যেমন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া দরকার, পাশাপাশি আজকের নবীনদেরও প্রবীণ বয়সের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

কিন্তু সেই প্রস্তুতিতে বড় ঘাটতি দেখতে পাচ্ছেন ড. রহমান। এজন্য সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে তিনি দায়ী করেন।

”আমাদের এমন কোন সোর্স নেই যেখান থেকে নবীনরা জানবে যে বার্ধক্য আসছে এবং তার জন্য কীভাবে সতর্ক হতে হবে। আগের তুলনায় গণমাধ্যমে কিছুটা খবর হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবেও কিছুটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষায়, পরিবারে, সামাজিকভাবে বার্ধক্য মোকাবেলার ক্ষেত্রে অসম্ভব রকম দীনতা আছে। ফলে তরুণদের মধ্যে কোন সচেতনতাও নেই।”

শনিবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে আলোচনায় বক্তরা বলেছেন, আজকের তরুণরাই আগামী দিনের প্রবীণ। যত দিন যাবে, তরুণ জনগোষ্ঠী বিপুল সংখ্যায় প্রবীণদের কাতারে নাম লেখাবে। তাদের জন্য সচেতনতা তৈরির কাজ এখনি তৈরি করতে হবে।

অধ্যাপক ড.এএসএম আতীকুর রহমান বলছেন, প্রবীণ হওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তার সঙ্গে শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবারের ব্যবস্থাপনা-অনেক কিছু জড়িত রয়েছে। সেগুলোর ব্যাপারে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া না থাকলে একটা সময়ে হঠাৎ বড় সমস্যায় পড়ে যেতে হয়।

তিনি বলছেন, ”সব মিলিয়ে আমরা একটা খুবই খারাপ অবস্থায় পড়ে যাচ্ছি। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে আজকে যারা নবীন, তারা অসম্ভব খারাপ একটা অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে।”

এসএইচ-০৬/০১/২২ (সায়েদুল ইসলাম, বিবিসি)