বিভ্রান্তি ছড়াতেই কূটনীতিকদের নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম!

সম্প্রতি বেশ কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিকের বক্তব্য রাজনৈতিক মাঠেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। তাদের কোনো কোনো মন্তব্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপেরও শামিল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, তাদের মুখ থেকে সরকারবিরোধী বক্তব্য বের করে নিয়ে আসতে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই তাদের এসব প্রশ্ন করা হচ্ছে। তারা বলছেন, বাইরের দেশের আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। যে কারণে তারা এসব কারসাজির আশ্রয় নিয়েছেন।

নির্বাচন ঘিরে যতটা উত্তাপ মাঠে আছে তার থেকে বেশি রয়েছে কুটনীতিকদের বক্তব্য ঘিরে। নিয়মিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। উত্তর আসছে কূটনীতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। এ ধরনের আপত্তিকর বক্তব্য না-দেয়ার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলেও থামেননি কয়েকটি দেশের কূটনীতিক।

যে-ই বা যারা এসব প্রশ্ন করছেন, তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘এতে ইন্ধন থাকতে পারে, বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।’

আয়োজক কারা?

সরকারকে চাপে রাখতে উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তি ছড়াতে কূটনীতিকদের নিয়ে আয়োজন করা হচ্ছে ডিকাপ টক, মিট দ্য প্রেস কিংবা মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর অনুষ্ঠান। গেলো কয়েকমাস ধরে তৎপর সেন্টার ফর গর্ভনেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) নামে একটি সংগঠন। তাদের আয়োজন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর নামে অনুষ্ঠান আয়োজন করছে গেলো বছর থেকেই।

সিজিএসের এসব অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। একটি সূত্র জানায়, তার সঙ্গে বিশেষ সখ্য রয়েছে বিএনপির মিডিয়া সেলের নিয়ন্ত্রক জহিরুদ্দিন স্বপনের। তার অনুষ্ঠানে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে দেখা যায় কিছু বিএনপি নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মাঠে শক্তিশালী না হলেও নির্দিষ্ট দল বিদেশি শক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে এসব তারই নমুনা। আর এদের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করে কিছু ব্যক্তি।

বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল আবদুর রশীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। এছাড়া মহামারির সময়ে করোনারোগীদের চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে টকশোতে নিয়ে ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ হিসেবেও পরিচয় করিয়ে দিতেন তিনি। ২০১৫ সাল থেকে তৃতীয় মাত্রায় দেখা গেছে সাহেদকে। এমনকি সাহেদের যেসব বক্তব্য সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তা-ও তৃতীয় মাত্রায় দেয়া। তৃতীয় মাত্রার অন্তত ২১টি পর্বে অতিথি হিসেবে দেখা গেছে মোহাম্মদ সাহেদকে।

সিজিএসের উপদেষ্টাদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আলী রিয়াজ ও ব্যারিস্টার রোকনুদ্দীন মাহমুদ। ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই আইনজীবী। তখন তিনি বলেন, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার চেয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো পদ্ধতি যতোদিন পাওয়া না যাচ্ছে, ততোদিন এ ব্যবস্থা চলা উচিত।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগে শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসাবে দেয়া বক্তব্যে তিনি এ মত প্রকাশ করেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সহিংসতা বন্ধ করার জন্য একটি মাত্র পথ, সেটা হলো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা।

২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপির আগুনসন্ত্রাসে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। স্কুলগামী শিশু থেকে শুরু করে পরিবহন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কেউই এই সন্ত্রাসের ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। এ সময় সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত পরিচালিত এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়।

আর বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বিএনপির সহিংস আন্দোলনের পক্ষে লেখালেখি করছেন আলী রিয়াজ। গেল ২ নভেম্বর এক লেখায় তিনি বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে ক্রমাগতভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার কারণে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন এবং তার অনুগতরা এক জৌলুশময় জীবন যাপন করছেন। দেশের অর্থ পাচারে রেকর্ড হয়েছে। লুটপাটের মাত্রা আগের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে।

আলী রিয়াজ দাবি করেন, এ সময় লোডশেডিং, জ্বালানির অব্যবস্থাপনা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ৩১ জুলাই ভোলায় বিএনপির মিছিলে গুলিতে মারা যান দুই কর্মী।

এদিকে ঢাকায় কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজন করে আসছে ‘ডিকাব টক’ নামের আরেকটি অনুষ্ঠান। সংগঠনটির সভাপতি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সানের নির্বাহী সম্পাদক রেজাউল করিম লোটাস, সাধারণ সম্পাদক ইউএনবির বিশেষ প্রতিনিধি একেএম মঈনুদ্দিন। এরআগেও তিন মেয়াদে সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন লোটাস।

ডিকাবের তিনবারের সভাপতি লোটাস শিক্ষাজীবনে ছাত্রদল করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি দীর্ঘদিন বিএনপি বিটে সাংবাদিকতা করেছেন। পরবর্তীতে কূটনৈতিক সাংবাদিকতা শুরু করেন।

এরআগে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের কূটনৈতিক প্রতিবেদক থকাকালেও তিনি এক নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি করেন। হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের সময় তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। তখন ডেইলি স্টার পত্রিকা এ ঘটনায় গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের কথা জানিয়েছে।

কূটনীতিকদের শিষ্টারবহির্ভূত বক্তব্য থামছে না

চলতি বছরের ১৬ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। ২২ আগস্ট তারা আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসনকে। বিএনপির এক নেতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ২৮ সেপ্টেম্বর তারা আমন্ত্রণ জানায়। পিটারও কথা বলেন গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন সময় জার্মান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে সেন্টার ফর গর্ভনেন্স স্টাডিজ (সিজেএস)। সবশেষ ১৪ নভেম্বর জাপান রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় রাজনীতির অঙ্গন।

গত ৮ নভেম্বর রাজধানীর প্রেসক্লাবের ‘ডিকাব টকে’ অংশ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেকে আহত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই উদ্বেগের বিষয়।

কীভাবে নিরাপদ উপায়ে কার্যক্রম চালানো যায়, সে বিষয়ে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন বলেও দাবি করেন।

এরআগে গেল ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিকাব টকে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথঅলি চুয়ার্ড বলেন, সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি। সুইস ব্যাংকের ত্রুটি সংশোধনে সুইজারল্যান্ড কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে আমি আপনাদের জানাতে চাই, সুইজারল্যান্ডে কালো টাকা রাখার কোনো নিরাপদ ক্ষেত্র নয়।

পরে গত ১১ আগস্ট বিষয়টি নজরে নিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের তথ্য কেন জানতে চাওয়া হয়নি তা রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে জানাতে বলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।

এদিকে গত ১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সুইস রাষ্ট্রদূত মিথ্যা বলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ফিন্যান্স সেক্রেটারি আমাকে আগে জানিয়েছিলেন, তারা তথ্য চেয়েছিলেন, তারা (সুইস ব্যাংক) উত্তর দেননি।

এরপর গত ১৪ আগস্ট সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তিদের অর্থ রাখার বিষয়ে তথ্য জানাতে সর্বমোট ৩ বার চিঠি দেয়া হয়েছিল বলে হাইকোর্টকে জানায় বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তখন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তিদের অর্থ রাখার বিষয়ে তথ্য জানানোর বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ডের বক্তব্য প্রত্যাহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।

আদালত আরও বলেন, রাষ্ট্রদূত কীভাবে বললেন বাংলাদেশিদের অর্থ জমার বিষয়ে কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি; তা আমাদের বোধগম্য নয়। সুইস রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য রাষ্ট্রকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আপনারা (রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবী) যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তাতে প্রমাণিত রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য সাংঘর্ষিক।

এরপর সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা বাংলাদেশিদের তথ্য জানানোর বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ডের বক্তব্য ভুল ছিল বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে সুইস অ্যাম্বাসি। ২৭ আগস্ট এ বিষয়ে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

গত ১৪ নভেম্বর সিজিএসের মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না। ইতো নাওকি বলেন, কাজেই এখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার। এটাই তার দৃঢ় প্রত্যাশা।

২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে। আর অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন জিল্লুর রহমান।

বিশ্লেষকরা বলছেন ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’

বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় ক্ষেত্রেই উপযাচক হয়ে নির্বাচন প্রসঙ্গে কূটনীতিকদের প্রশ্ন করেছেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। এছাড়াও কিছু আয়োজনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি নেতাকে আমন্ত্রণ করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু বিএনপির নির্দিষ্ট দুয়েকজন নেতাকে আমন্ত্রণ করে সংগঠনটি। তারাও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্ন করেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কূটনীতিকরা স্বতঃপ্রণোদিত কোথাও মন্তব্য করছেন না। বরং নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে ডেকে এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন করা হচ্ছে তাদের।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কূটনীতিবিদরা কথা বলতে পারছেন এই কারণে যেহেতু তাদের একটা প্ল্যাটফর্ম দেয়া হচ্ছে। তারা নিজেদের ইচ্ছায় প্রেস কনফারেন্স করছে এমনটা না। সুযোগটা দেয়া হচ্ছে বলেই তারা কথা বলছেন। আবার এটিও হতে পারে যে এই বিভাজন রাজনীতি তাদের স্বার্থ অনেককে কাজে দেয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, বিরোধীদলও বহিঃআশির্বাদ নিয়ে নির্বাচনে যায়। তাই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাদের হস্তক্ষেপের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ২০১৮ সালে দেখেছিলাম মার্শাল বার্নিকাট যখন বলেছিলেন ত্বত্তাবধায়ক সরকার ছাড়াই বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত তখন কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে গেল।

এই অনুষ্ঠান থেকে আসা রাষ্ট্রদূতদের বক্তব্য নিয়ে ক্ষিপ্ত খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বলছে নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডার ইঙ্গিত বহন করে এসব বক্তব্য।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ায় আলম বলেন, কোনো রাষ্ট্রদূতকে তোয়াজ করে নিয়ে এসে তাকে দেশের আভ্যন্তরীণ প্রশ্ন করছেন। সাম্প্রতিক সময়ের যে বিষয়গুলো এগুলো অনেকের কার্যক্রমকে দেখে মনে হচ্ছে তাদের সিংগেল পয়েন্ট এজেন্ডা হচ্ছে যেসব দল সংসদে নেই, রাজপথে নেই এবং যেসব দলের নেতৃত্ব সংকট আছে তাদেরকে শক্তিশালী করা।

কূটনীতিকদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন মেনে আচরণ করার তাগিদ দেন প্রতিমন্ত্রী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কূটনৈতিকদের শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্যে রাজনৈতিক ইন্ধনের বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু রাজনৈতিক প্ররোচনা থাকলেও দেশের বাইরে ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে নিজেদের কার্যক্রম চালাতে হবে একজন কূটনীতিককে।

‘একজন রাষ্ট্রদূতের যে আচরণ, নিয়মনীতি ও বিধিবিধান—সেগুলো মেনে চলাই ভালো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই রীতি কিছুটা লঙ্ঘিত হচ্ছে। এটা আজ নতুন করে হচ্ছে, তা না। বহুদিন থেকে আমরা লক্ষ্য করছি। এটার জন্য আমরা নিজেরাও দায় অস্বীকার করতে পারছি না।’

ঢাবির সাংবাদিকতা বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, আমরা তাদের বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাই, তারা যখন সরকারি ও বিরোধীদলের নেতানেত্রীদের সঙ্গে দেখা করে, তখন তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। এই প্রচারে কূটনীতিকদের চেয়ে আমাদের লোকজনই বেশি আগ্রহী। এসব কারণে আমরা নিজেরাও দায় এড়াতে পারি না।

অথচ বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকরা যখন কাজ করেন, তখন নীরবে কাজ করেন বলে জানান আরেফিন সিদ্দিক। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশে তারা (কূটনীতিকরা) যখন কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন, তা ফলাও করে প্রচার করা হয় না। কারণ এটা তাদের রুটিন কাজ।

আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, কিন্তু বাংলাদেশে তাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রধান অতিথি করে নিয়ে এসে এমন প্রশ্ন করা হচ্ছে, যাতে তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত জবাব দিতে বাধ্য হন। সবকিছু মিলিয়েই আমি বলব, কূটনীতিকদের যেমন দায়িত্ব আছে, যা অস্বীকার করা যাবে না। আবার আমরাও দায়িত্ব এড়াতে পারব না। তাদের প্রচারের মধ্যে নিয়ে আসি আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। যেমন জাপানের রাষ্ট্রদূত যে কথাটা বলেছেন, তা তিনি একটা প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন। তাকে এই ধরনের আয়োজনে নিয়ে এসে প্রশ্ন করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে।

যে-ই বা যারা প্রশ্ন করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। এই অধ্যাপক বলেন, ভারতে রাষ্ট্রদূতরা যখন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তা সংবাদই হয় না।

মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর ও ডিকাব টকের মতো অনুষ্ঠানগুলোতে তাদের আসা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তারা আসতে পারেন। তবে তাতে দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন আসলে তারা তা নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন।

এসএইচ-১০/১৯/২২ (অনলাইন ডেস্ক)