কর্ণফুলী টানেল সরকারের মাথাব্যথার কারণ হবে!

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে যে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মিত হচ্ছে সেটির দক্ষিণ টিউবের কাজ শেষ হয়েছে।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ জানান, আগামী বছর জানুয়ারির শেষ নাগাদ পুরো টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন তারা।

আর পুরো কাজ শেষ হলে তখন টানেলটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নামে এই টানেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

এর আগে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং’কে সাথে নিয়ে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ চলছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৯হাজার ৮৮০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশে সরকারের অর্থ সহায়তা থাকবে তিন হাজার ৯৬৭ কোটি টাকার মতো। বাকি টাকা আসবে চীনের কাছ থেকে।

এই প্রকল্পটিতে চীন পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী টানেলটি মূলত আনোয়ারা উপজেলাকে চট্টগ্রামের মূল শহরের সাথে যুক্ত করবে।

এই প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ৪ লেনের সড়ক টানেল নির্মান করা হবে।

মূল টানেলে থাকবে দুটি টিউব। যার দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এছাড়া টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি সংযোগ সড়ক থাকবে। সাথে থাকবে ৭শ ২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ওভারব্রীজ।

জানা যাচ্ছে যে, এরইমধ্যে এই টানেলের নির্মাণ কাজ ৯০ শতাংশের মতো সম্পন্ন হয়েছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন করাই এই টানেলটি নির্মাণের অন্যতম কারণ।

টানেলটি চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের সাথে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ চালু হবে।

ফলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার দূরত্ব কমে আসবে। বাঁচবে খরচ এবং সময়ও।

ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সাথেও সংযোগ স্থাপন করবে এই টানেল।

সেই সাথে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব দিকে শহরাঞ্চলকে যুক্ত করে সেখানে উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এটি।

ওই এলাকায় যে শিল্প এলাকা গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে সেটির কাজও শুরু হবে জোরেসোরে।

অন্যদিকে পশ্চিম দিকে চট্টগ্রাম মূল শহরের সাথে সাগর ও বিমান বন্দরেরও দূরত্ব কমে আসবে।

কম খরচে ভ্রমণ আরো সহজ হবে। আর দুই বন্দর থেকেই মাল পরিবহন সহজ হবে।

এছাড়া টানেলটি নির্মাণের পর চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ সুবিধা বাড়বে। যার কারণে গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজও এগিয়ে যাবে।

সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, টানেল নির্মাণ শেষ হলে চট্টগ্রাম শহরকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে “ওয়ান সিটি টু টাউন” বা “এক নগর দুই শহর” এর মডেলে গড়ে তোলা হবে।

টানেলটি দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে এর প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, এই টানেল চালু হলে সেটি দেশের জিডিপিতে বার্ষিক শূণ্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী নদীর উপর যে টানেলটি গড়ে তোলা হচ্ছে সেটি আসলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য একটি ভাল প্রকল্প হিসেবে দেখা দিতে পারে।

কিন্তু স্বল্পমেয়াদে এটি আসলে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিনড্রাইভ সড়কটি যদি সম্পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে মেরিনড্রাইভের পাশে অনেকগুলো শিল্প এলাকা গড়ে উঠবে।

“অতএব লং টার্ম বিবেচনা করলে এটা গুড প্রজেক্ট,” বলেন তিনি। কারণ এটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব কমিয়ে দেবে।

তবে তিনি মনে করেন স্বল্পমেয়াদে এটার আয় দিয়ে এটি নির্মাণে যে খরচ হয়েছে সে খরচ তোলা যাবে না।

“সেদিক থেকে এটা শর্ট টার্মে এটা বোঝা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের উপরে,” মি. ইসলাম বলেন।

আগামী ৫-৭ বছরে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, কারণ আগামী ৫-৭ বছরে এটা পর্যাপ্ত ব্যবহৃত হবে না। এতে যথেষ্ট পরিমাণ গাড়ি চলাচল করবে না। ফলে প্রথম দিকে এটি বাংলাদেশের উপরে একটি বোঝা হয়ে থাকবে।

মি. ইসলাম বলেন, ২০২৫ সাল থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা শুরু হয়ে যাবে। আর স্বল্প মেয়াদে যে লাভ হবে এই টানেল থেকে সেটি ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট হবে না।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সহসাই হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

“এই পর্যায়ে এসে এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নাই। এটা আন্ডার ইউটিলাইজ (কম ব্যবহৃত) হবে কয়েক বছর, এটা মেনে নিতেই হবে, ” বলেন তিনি।

তবে যদি চট্টগ্রাম বন্দরের কিছু জেটি কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে সরানো যায় তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে।

অর্থনীতির সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, এগুলো সম্ভাব্য সুবিধা এবং এসব চিন্তা করলে টানেলটা একটা ভাল প্রকল্প।

এসএইচ-১২/২৬/২২ (মুন্নী আক্তার ,বিবিসি)