ডিসেম্বরে চালু হতে পারে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

দেশে পরিবেশ ইস্যুতে বহুল আলোচিত-সমালোচিত রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে পারে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আভাস দিয়েছেন।

আপাতত প্রকল্পের দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিট তার সর্বোচ্চ সক্ষমতায় ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে কিনা, সে বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সঞ্চালন লাইনে দেয়া হয়।

সেখানে কিছু সমস্যা ধরা পড়ায় সেগুলো সমাধানে কাজ চলছে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন জানান, সব ঠিকঠাক থাকলে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারের (এনএলডিসি) সনদ পাওয়া যাবে। সে হিসেবে ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন লাইনে প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণাধীন কেন্দ্রটির প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট করে। সে হিসেবে কেন্দ্রটির পূর্ণ সক্ষমতা হল দৈনিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।

প্রথম ইউনিট থেকে একবার বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলে, দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করা হবে।

এরিমধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটের অবকাঠামোগত কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সাধারণত প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

সে হিসেবে সামনের বছরের মার্চ নাগাদ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তাদের পূর্ণ সক্ষমতায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে বলে জানান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন।

এতে করে খুলনা ও আশেপাশের এলাকাসহ চাহিদা সাপেক্ষে সারাদেশে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে বল তিনি জানান।

এর আগে গত ১৫ই আগস্ট কেন্দ্রটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা হলেও গত ২৪শে অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়।

এর প্রায় এক মাস পর পুনরায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা হল।

রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র শুরু থেকেই আলোচনায় আছে এর পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে।

বাংলাদেশে দক্ষিণে খুলনা বিভাগের, বাগেরহাট জেলার, রামপাল উপজেলার যেই স্থানটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখান থেকে সুন্দরবনের বাফারজোনের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার বলে সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে।

যদিও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা বলছেন এই দূরত্ব আরও কম ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটারের মধ্যে।

এতো অল্প দূরত্বে এই কয়লাভিত্তিক এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন।

নানা বিতর্কের এক পর্যায়ে জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালের অক্টোবরে এই প্রকল্পের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের বিষয়ে ত্রিশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

সেখানে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মূলত চার ধরণের ক্ষতির আশংকার কথা তুলে ধরা হয়। • রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে কয়লা পুড়িয়ে। এই কয়লা পোড়ানোর পর সেখান থেকে থেকে নির্গত কয়লার ছাইকে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ইউনেস্কোর এই প্রকল্পে। • বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য এবং পানিকে দ্বিতীয় হুমকি গণ্য করছে ইউনেস্কো। • এই প্রকল্পকে ঘিরে সুন্দরবন এলাকায় যেভাবে জাহাজ চলাচল বাড়বে এবং ড্রেজিং করার দরকার হবে, সেটিও সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। • আর সবশেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে ঐ অঞ্চলের সার্বিক শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন কর্মাকান্ড সুন্দরবনের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করে ইউনেস্কো।

ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল কনজার্ভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) এর তিনজন বিশেষজ্ঞ সরেজমিনে ঘুরে দেখে এবং বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ প্রভাব যাচাইয়ের (ইআইএ) জন্য আইউসিএন যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা ঠিকমত মেনে চলা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় ওই রিপোর্টে।

শুরু থেকেই এই বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে সুন্দরবন ও এর প্রাণী বৈচিত্র্য ধীরে ধীরে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। যা বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশের জন্য অশনি সংকেত বলে তিনি মনে করেন।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যান্য ধরনের যেকোনো ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র্র থেকে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ে। এছাড়া বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, সীসা, ছাই ইত্যাদি গ্যাস ও ভারী ধাতুর পরিবেশে নির্গমনের ফলে পরিবেশ দূষণের কবলে পড়বে সুন্দরবন ও আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে এতে এসিড-বৃষ্টি অবধারিত, সেইসাথে বিষাক্ত বাতাস ও রাসায়নিক সুন্দরবনের বনাঞ্চল, পরিবেশ ও জীব-সম্পদের জন্য বিপজ্জনক, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের টিকে থাকার জন্য আশংকাজনক হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতি এড়াতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ধরণের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং যেরকম আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা উচিৎ, সেটাও করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে।

এ ব্যাপারে আনু মোহাম্মদ বলেন সরকার যে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষতি কমিয়ে আনার কথা বলছেন সেটি অনেকটা সাগরের বুক থেকে এক বালতি পানি সরানোর মতো।

সাধারণত কয়লা যদি উচ্চতাপে পোড়ানো হয় তাহলে অল্প কয়লায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তাপমাত্রা যতো বেশি হয় সেক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণও কমিয়ে আনা যায়।

মূলত সুপার ক্রিটিকাল ও আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির মধ্যে এই তাপমাত্রার পার্থক্য রয়েছে।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দূষণ সবোর্চ্চ ১০% কমানো যাবে। যে হারে পরিবেশের ক্ষতি হতে যাচ্ছে সেখানে ১০% কম দূষণ কোন পরিবর্তন আনবে না বলে দাবি করেন প্রফেসর মোহাম্মদ।

আনু মোহাম্মদ বলেন, “পৃথিবীতে এমন কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। সরকার সুপার ক্রিটিকাল, আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির কথা বলছেন সেটা যে ক্ষতি কমাতে পারবে না। সেটার বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন আমরা সরকারকে দিয়েছে। তারা ভ্রুক্ষেপ করেনি।”

সুপার ক্রিটিকাল, আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির মধ্যে মূলত তাপমাত্রার পার্থক্য রয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশবাদী সংস্থাসহ ইউনেস্কো সুন্দরবনের কাছে এই বিশাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বারবার আহবান জানিয়েছে।

পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টিকে মাথায় রেখে যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

সেখানে এরকম একটি প্রকল্প বাংলাদেশে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীব-বৈচিত্র্যের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করবে বলে তিনি জানান।

প্রকল্পটি পুরোদমে চালু হলে বা মোট ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন করলে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার টন কয়লা পোড়ানোর হতে পারে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সে হিসেবে প্রতি বছর পঞ্চাশ লাখ টনের বেশি কয়লা পোড়ানো হতে পারে।

এরিমধ্য তিন লাখ টন ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনা হয়েছে। কয়লা নিতে অস্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে কথা বলা হলেও দূরত্ব বিবেচনায় পরিবহন খরচ কমাতে ইন্দোনেশিয়াকে বেছে নেয়া হয়।

তবে বিভিন্ন দেশ থেকে গভীর সমুদ্রপথে যখন আমদানি করা হবে, সেগুলো কয়েক ধাপে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাবে।

যেহেতু সুন্দরবনসংলগ্ন নদীপথ জাহাজ চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয় এ কারণে পশুর নদীতে ড্রেজিং করা হচ্ছে। সেখানে ছোট ছোট নৌকা ও লঞ্চের মাধ্যমে কয়লা বহন করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেয়া হবে।

এতে একদিকে কয়লাভর্তি নৌকাডুবি বা পরিবেশে এসব খনিজ কয়লা নিঃসৃত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া মালামাল ওঠানামা ও চলাচলের কারণে যে শব্দ, আলো ও জ্বালানির ব্যবহার হবে সেটাও বনের জীববৈচিত্রের ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে দাবি করে আসছেন পরিবেশবাদীরা।

এছাড়া যেসব দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে, তার আশপাশের মানুষ ও জনপদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ক্যানসার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও নিউরোডিজেনারিটিভ স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গিয়েছে।

সব মিলিয়ে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল কনজার্ভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) এর ভাষ্য, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে খুব প্রবল আশঙ্কা রয়েছে যে সুন্দরবন, এর প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনপদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

যদিও পরিবেশবাদী সংগঠনের এসব দাবি ও আহ্বান বারবার নাকচ করে দিয়েছে সরকার। তাদের দাবি, এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে প্রথম সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। সেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের একটি প্রস্তাবনা ছিল।

এর ভিত্তিতে ২০১২ সালে বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের,বাগেরহাট জেলার রামপালে দুটি ৬৬০ ইউনিট মিলে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর সঙ্গে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) এই চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর থেকেই শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ।

প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাঃ) লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ওপর।

এসএইচ-১৩/২৭/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)