ভাল ফলের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবনে!

সোমবার এসএসসি পরীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশ হয়েছে সেখানে পাসের হার গত বছরের চাইতে কিছুটা কম হলেও জিপিএ ফাইভের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনেকেরই ভালাফলের প্রতিফলন তাদের কর্মজীবনে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।

গত কয়েক দশক ধরেই এসএসসিসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বোর্ড পরীক্ষার পাসের হার গড়ে ৮৫-৯৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে ।

অথচ গত তিন দশক আগেও এসএসসি বা তৎকালীন মেট্রিক পরীক্ষায় পাসের হার থাকতো ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে। এর পেছনে গ্রেডিং পদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনকে বড় কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের শেখানোর পরিবর্তে তাদের মুখস্থ করিয়ে ভাল ফল করার ওপরেই কতো কয়েক দশক ধরে জোর দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অস্থির প্রতিযোগিতা হচ্ছে জিপিএ ফাইভ নিয়ে।

খাতা মূল্যায়নের শিথিলতার কারণেও ফলাফলে এতো আমূল পরিবর্তন এসেছে।

প্রতিবছর এতো ভুরি ভুরি জিপিএ ফাইভ এবং হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতভাগ পাস নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হয়।

কারণ এই শিক্ষার্থীদের অনেকেরই জিপিএ-তে ভাল ফলের প্রতিফলন তাদের কর্মজীবনে সেভাবে দেখা যায় না।

নিয়োগকর্তা এবং শিক্ষাবিদরা প্রশ্ন তুলছেন পাসের হার যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মান কতোটা বাড়ছে, সেটা নিয়ে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মানের ঘাটতি লক্ষ্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক আতিকুন নাহার।

তিনি বলেন, “ভর্তি পরীক্ষায় আমরা একজন ভাল স্কোর পাওয়া শিক্ষার্থীর কাছে যে সাধারণ জ্ঞান আশা করি। বেশিরভাগ সময় তা পাই না। বাংলা আর ইংরেজিতে তারা অনেক পিছিয়ে আছে। দুই বছর আগে তো ইংরেজিতে বড় ধস নেমেছিল। পাস মার্কসও দেয়া যাচ্ছিল না।”

তবে তিনি শিক্ষার্থীদের নয় বরং শিক্ষা পদ্ধতির ওপর দোষারোপ করেছেন।

তার মতে, শিক্ষা ব্যবস্থা যতদিন পরীক্ষার ফল কেন্দ্রিক এবং সিলেবাস কেন্দ্রিক থাকবে, ততদিন মানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হবে না।

এসএসসি এবং এর পরবর্তী পরীক্ষাগুলোয় যে কেমন ফল করেছে সেটা চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্ব রাখে।

তবে এর চেয়ে বেশি দেখা হয় তাদের বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা, বাকপটুতা এবং ডিজিটাল দক্ষতা কতোটা আছে। নিয়োগ-দাতারা এমনটাই দাবি করছেন।

সাধারণত চাকরিতে কাউকে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আবেদনকারীদের পূর্ববর্তী বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল ও কাজের অভিজ্ঞতা যাচাই করে তাদের শর্ট-লিস্ট করেন।

কিন্তু তাদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেবার সময় পরীক্ষার ফল ও দক্ষতা প্রমাণের জায়গায় বড় ধরণের ফারাক দেখার কথা জানান বাংলাদেশ এপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি কামরান টি রহমান।

তিনি দেখেছেন মধ্যম মানের ফলাফল করেও অনেকে ইংরেজি ও প্রমিত বাংলা ভাষায় ভাল দখল, নিজেকে উপস্থাপন, বিশেষ করে কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষতা প্রমাণ করতে পেরেছেন, যা হয়তো তার চেয়ে ভালো ফল করেও অনেকে পারেননি।

সেইসঙ্গে প্রতিবছর যে হারে পাসের হার ও জিপিএ ফাইভ বাড়ছে, নিয়োগের সময় সেই হারে ভাল রেজাল্টের কোন প্রতিফলন দেখতে পাননি তিনি।

এক্ষেত্রে বাজারে কোন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কী শেখাচ্ছে সেখানে বড় ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন মি. রহমান।

“ইন্ডাস্ট্রি কী চায়, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের কী শেখায় এই দক্ষতার গ্যাপ কমে গেলে পরিস্থিতি ইম্প্রুভ করবে। ইন্ডাস্ট্রি তাদের প্রয়োজন মাফিক দক্ষ লোক পাচ্ছে না। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে সফট স্কিলগুলো শেখানো।”

তিনি এখানে সফট স্কিলস বলতে প্রমিত বাংলা বলা, নির্ভুল ইংরেজিতে কথা বলা, নিজেকে উপস্থাপন করা, আদবকেতা, আত্মবিশ্বাস, কম্পিউটারে দক্ষতা শেখানোর কথা বলেছেন।

রহমানের মতো শিক্ষাবিদরাও কর্মমুখী ও উৎপাদনশীল শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষাখাতে গবেষণার ওপর।

শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক আতিকুন নাহার মনে করেন, শিক্ষা নিয়ে যতো বেশি গবেষণা হবে ততো বেশি এর ঘাটতির জায়গাগুলো বেরিয়ে আসবে। সেগুলো চিহ্ণিত ও সমাধান করলেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

কারণ মেধা যাচাই ও উত্তীর্ণ করতে প্রতি বছর যে পরীক্ষা নেয়া হয়, সেই ২-৩ ঘণ্টায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত মেধার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। তার মতে, সারা বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

জাতিসংঘের ১৯৪৮ এর ডিক্লারেশনে পরিষ্কার বলা আছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে সবার জন্য। মাধ্যমিক শিক্ষা হবে কর্মমুখী, যা কর্মপোযোগী জনগোষ্ঠী তৈরি করবে। উচ্চশিক্ষায় নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। যিনি মেধাবী হবেন তিনিই উচ্চশিক্ষা নেবেন।

কিন্তু এই মেধা মূল্যায়নের জন্য যে ছাঁকুনি প্রক্রিয়া আছে সেটাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন আতিকুন নাহার।

তিনি বলেন, “আমরা মেধা যাচাইয়ের জন্য ২/৩ ঘণ্টার পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। এতে আসলে একজন শিক্ষার্থীর মেধা বা অর্জনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। এজন্য সারা বছর ধরেই তাকে মূল্যায়নের একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে।”

শিক্ষাবিদরা বলছেন যদি দেশের সব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় তাও বলা যাবে না যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গুণগত-মান অর্জন করেছে।

কারণ এই মান নির্ভর করে শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা এবং মানসম্মত শিক্ষকের ওপর।

এই বিষয়গুলোর উন্নয়নে শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ঠিক রাখা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব কমানো, পাঠদানের সময় বাড়ানো, বই সন্নিবেশ, বিভিন্ন সৃজনশীল সহশিক্ষা কার্যক্রমের আয়োজন, পুরো প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের মনিটরিং এবং নিয়মিত গবেষণার ওপর শিক্ষাবিদরা জোর দিচ্ছেন।

সৃজনশীল সহশিক্ষা কার্যক্রম শুধু ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীদের ভাষা শেখানো, আত্মবিশ্বাস অর্জন, বিশেষ করে যার যেদিকে আগ্রহ সেদিকে গুরুত্ব দেয়ার ওপর জোর দেবার পরামর্শ তারা দিয়েছেন। সেটি সাংস্কৃতিক চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা, খেলাধুলা, বিতর্ক, পড়াশোনা, যেকোনো কিছু হতে পারে।

এক্ষেত্রে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শও তারা দিয়েছেন।

তাদের মত হল, শুধু ভাল ফল বা জিপিএ বৃদ্ধি অথবা হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ পাসের হিসাব দিয়ে দেশের শিক্ষার মান কোনোভাবেই বিচার করা যায় না।

এসএইচ-১৭/২৮/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)