দেশে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার

দেশে আইনে শিশুদের অধিকার অনেক৷ তাদের অধিকার লঙ্ঘন হলে শাস্তির কথাও বলা আছে আইনে৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এখনো প্রতিকূল৷ এখনো শিশুদের অধিকারই সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন হয়, শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়৷

গত ২১ এপ্রিল মিরপুর এলাকার আট বছরের একটি শিশু ৯৯৯-এ ফোন করে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে৷ তার অভিযোগ হলো বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করে৷ মা তাকে মারধর করে৷ মিরপুর থানা পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর ওই দিনই শিশু ও তার মা-কে থানায় নিয়ে আসে৷ মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানান, ‘‘থানায় ডেকে কথা বলার পর আমরা এখন কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করেছি৷ শিশুটি এখন বাবা-মায়ের সঙ্গেই আছে৷ আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং ছাড়াও খোঁজ-খবর রাখছি৷ মায়ের কিছুটা মানসিক সমস্যা আছে বলে মনে হ্চ্ছে৷ তবে নতুন করে কোনো অভিযোগ সে করেনি৷’’

শিশুটিকে তার বাবা ও স্কুলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কোনো বিপদে পড়লে যেন ৯৯৯-এ ফোন করে৷ শিশুটি এভাবেই ৯৯৯-এর কথা জেনেছিল বলে জানান মোহাম্মদ মোহসিন৷

জাতীয় জরুরি সেবার (৯৯৯) পুলিশ ইন্সপেক্টর (মিডিয়া) আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘‘আমরা শিশুদের (১৮ বছর পর্যন্ত বয়স যাদের) নানা অভিযোগ নিয়ে কল পাই৷ এই অভিযোগের বড় একটি অংশ হলো পরিবারে তারা মারধর বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ কিছু সমস্যা আমরা ফোনেই সমাধান করে ফেলি৷ আর যেগুলো জটিল, সেগুলো আমরা সংশ্লিষ্ট থানাকে দায়িত্ব দিই৷ তবে অভিযোগের একটি অংশের সত্যতা পাওয়া যায় না৷ বাবা-মায়ের প্রতি কোনো কোনো ক্ষোভের কারণে কেউ কেউ অভিযোগ করে৷ আর পরীক্ষার সময় আমরা প্রচুর কল পাই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে৷’’

তিনি জানান, ‘ বৃহস্পতিবার আমরা একটি মেয়ের অভিযোগ পেয়েছি৷ মেয়েটি বলছে, তার মা তাকে মারধর করে৷ মা বলছেন, মেয়েটি অবাধ্য এবং প্রেম করে৷ আমরা বিষয়টি দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে যুক্ত করেছি৷’’

অভিযোগ গ্রহণের পর নিয়মিত ফলোআপ করা হয় বলেও কথা জানান তিনি৷

তিনি জানান, ২০২২ সালে তারা ৮৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৩৪টি কল পেয়েছেন৷ এর মধ্যে শিশুরা কল করেছে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৯টি৷

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে একটি শিশু সহায়তা সেল আছে, যার নাম্বার ১০৯৮৷ টোল-ফ্রি এই নাম্বারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ফোন করে তাদের সমস্যা বা অভিযোগ জানাতে পারে৷ তারা আইনিসহ সব ধরনের সহায়তা করে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, তারা ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাত লাখ ৮৩ হাজার ৮৪৫টি কল গ্রহণ করেছেন৷ তার মধ্যে ৯ হাজার ৮৭২ টি শিশু নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার, আট হাজার ৩৪৭ টি পরিবারিক সমস্যা সমাধান, ১১ হাজার ২১৩ জন গৃহহীন ও সহায়সম্বলহীন হারিয়ে যাওয়া শিশুর নিরাপদ আবাস বা পরিবারে স্থানান্তর, ২০ হাজার ১৩৮ জন শিশুকে আইনি সহায়তা, ৫৩ হাজার ৪৫৩ জন শিশুকে স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য ও পরামর্শ প্রদান, ১৯ হাজার ২১৭ জন শিশুকে বিদ্যালয়ে পড়াশুনার ব্যাপারে, স্কুল শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সহায়তা, ৬৬৮ জনকে মাদক ও অন্যান্য নেশার ব্যবহার ও ক্ষতি সম্পর্কে পরামর্শ ও নিরাময় সেন্টারে রেফার এবং দুই হাজার ৯৯৭ জন শিশুর বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন৷

সেলের ম্যানেজার মোহাইমেন চৌধুরী বলেন, ‘‘শিশুদের অভিযোগগুলো ১৯৮টি ভাগে ভাগ করা যায়৷ আমাদের কাউন্সেলিংয়ের টিম আছে৷ মোবাইল টিম আছে৷ সারা দেশে নেটওয়ার্ক আছে৷ আমরা প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সবার সহায়তা নিই৷ ফোন পাওয়ার পর তার তথ্য নিয়ে তাতে সহায়তা করি৷ এটা ফলোআপের মধ্যে রাখা হয়৷ আর শুধু শিশু নয়, তার সমস্যা নিয়ে অভিভাবক, প্রতিবেশী এমনকি পথচারি পর্যন্ত সবাই আমাদের সহায়তা চাইতে পারেন৷ আমরা শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী তাদের সহায়তা করি৷’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা ২৪ ঘণ্টা সহায়তা দেই৷ প্রতিদিন গড়ে ৯০০ থেকে ১২০০ কল পাই৷ তবে আমরা ১০ ধেকে ১৫ ভাগ মানুষের কাছে পোঁছতে পেরেছি৷ তাই আমরা নানা ধরনের প্রচার চালাচ্ছি৷ আমাদের ফেসবুক পেজেও অভিযোগ করা যায়৷ কাউকে চিহ্নিত করতে আমরা প্রয়োজনে ফেসবুক কর্তৃপক্ষেরও সহায়তা নিই৷’’

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ২২৫টি শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৮ জন৷ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৩ জন৷ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ছয় জন, শিক্ষকের হাতে ৩৬ জন৷ ২০২২ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৮৮টি শিশু, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০১ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১০২ জন৷ পরিবারে ২৪ জন এবং শিক্ষকের হাতে ১০৯ জন৷ সংস্থাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব দিয়েছে৷ বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি৷

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১২৮টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ২০২২ সালে হত্যার শিকার হয়েছে ৫১৬টি শিশু৷ হত্যার ঘটনায় শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে মামলা হলেও নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হার শতকরা ৪০ ভাগের বেশি নয়৷

শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়েও আছে নানা বিচ্যুতি৷

মাধ্যমিকে দুই বছরে চার লাখেরও বেশি শিশু ঝরে পড়েছে৷ তাদের মধ্যে মেয়ে ৬২.৬৩ শতাংশ৷ সারাদেশে ২৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করলেও সেখান থেকে ঝরে গেছে চার লাখের বেশি৷ এই সময়ে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কমেছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার৷ প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) এসব তথ্য উঠে এসেছে৷ প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার এখন ১৪.১৫ শতাংশ৷ তিন ভাগ শিশু স্কুলেই যায়না৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ৫৮৬ সরকারি হাসপাতালে জীবিত জন্ম নিয়েছে চার লাখ ৪৭ হাজার ১৭১ শিশু৷ প্রতি হাজার জীবিত জন্মে প্রায় ২৪টি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, যা চার বছরে সর্বোচ্চ৷ ২০২১ সালের তুলনায় এই হার ৩৩ শতাংশ বেশি৷ বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০২০ সালের তথ্যমতে, দেশে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৫৷

বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী তিন লাখেরও বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে৷ মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের মধ্যে মারাত্মক অপুষ্টির কেন্দ্রস্থল ভারত এবং পাকিস্তান ৷ ভারতে অপুষ্টির শিকার ৫৭ লাখ ৭২ হাজার ৪৭২ জন শিশু, পাকিস্তানে অপুষ্টির শিকার ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৯২৫ জন৷ আর বাংলাদেশে তিন লাখ ২৭ হাজার ৮৫৯ জন শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে৷
শিশুর অধিকার ও শিশু আইন:

বাংলাদেশে শিশু আইন ২০১৩ তে শিশুদের অধিকার এবং তাদের অধিকার লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান আছে৷ শিশু অধিকার কীভাবে কার্যকর করা হবে তাও বলে দেয়া আছে৷ এই আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়৷ আইনটি বাস্তবায়নের বড় দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদপ্তরের৷ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নেই এই আইনটি করা হয়৷ কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ তেমন হচ্ছেনা৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন,” রাষ্ট্র ও সমাজের নানা সংস্থা শিশুদের প্রতি বেআইনি আচরণ করছে৷ ১৮ বছরের কম বয়সি একটি শিশুকে আটক করে পুলিশ তার বয়স ২১ বছর দেখাচ্ছে৷ তখন সে এই আইনের প্রটেকশন পাচ্ছেনা৷ আদালতে তখন বয়স নির্ধারণের প্রশ্ন আসে৷ ততদিনে শিশুটি প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গে কারাগারে থেকে হয়তো অপরাধী হয়ে ওঠে৷ এখানে সমাজসেবা দপ্তরের প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব আছে৷ কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালন করেন না৷”

“বাংলাদেশে বাস্তবে আলাদা শিশু আদালত নেই৷ কোনো একটি আদালতকে বাড়তি শিশু আদালতের দায়িত্ব দেয়া হয়৷ ফলে শিশুদের প্রতি কী আচরণ করতে হবে তা তারা জানে না৷ শিশুকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়৷ তাদের প্রতি নির্মম আচরণ করা হয়,” বলেন এই আইনজীবী৷

তার কথা,” শিশুর প্রতি সহিংসতার বীজ আমাদের এই সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারে আছে৷ শিশুর অধিকার লঙ্ঘন করলে তেমন বিচার হয় না৷ তাই শিশুর অধিকারও প্রতিষ্ঠা পায় না৷”

আইনে অনেক কমিটি, ব্যবস্থা ও সিস্টেমের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলো নেই বলে জানান তিনি৷
শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন “অপরাজেয় বাংলাদেশ”-এর প্রধান ওয়াহিদা বানু মনে করেন, ” শিশুদের নিয়ে আইন এবং অনেক নীতি তৈরি করা হলেও সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে অনেক ধীর গতিতে৷ শিশুরা ভোটার না তাই রাজনীতিবিদরা তাদের দিকে নজর দিতেন৷ তারা যদি ভোটার হতো তাহলে নির্বাচনের আগে হলেও তারা তাদের জন্য কিছু করতো৷”

তার কথা,” শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের পাচার করা হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাদের অপরাধমূলক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে কিন্তু এর তেমন কোনো বিচার নেই৷ শিশুরা ঘর, স্কুলসহ সব জায়গায় সহিংসতার শিকার হচ্ছে কিন্তু প্রদিকার তেমন নেই৷”

“শিশু আইনের সুবিধা শিশুরা না পেলেও এর সুবিধা নিচ্ছে অপরাধীরা৷ কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে বয়স্ক অপরাধীরা৷ শিশুদের ব্যবহার করছে৷ কারণ, তারা জানে শিশু আইনে তারা কী সুবিধা পারে৷ কিন্তু নেপথ্যের অপরাধীকে ধরা হচ্ছে না৷ অপরাধীদের কারণে শিশুরা মাদকে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন তিনি৷
তিনি মনে করেন,”শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিসহ সব অধিকার নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে৷”

এসএইচ-০২/২৯/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)