নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি অনড়, আ’ লীগ দ্বিধাগ্রস্ত?

দেশের রাজনীতিতে প্রায় নিয়মিত উঠে আসছে নতুন নতুন আলোচনা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সক্রিয়তা, আওয়ামী লীগ নেতাদের পরস্পরবিরোধী কথা আর বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের পক্ষে অনড় অবস্থান নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেছেন, “বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার দরজা খোলা আছে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপ হবে।” ১৪ দলের বৈঠক শেষে তিনি এই কথা বলেন। কিন্তু বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ” আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করবো আমাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে। প্রয়োজন হলে নিজেরাই সমাধান করবো। এখানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে-এমন রাজনৈতিক সংকট দেশে তৈরি হয়নি।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেদিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গেও বৈঠক করেন। বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে তিনি যে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছেন তা মহাচিবই জানিয়েছেন। তবে সরকারের দুই প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে বলা হচ্ছে শ্রম আইনের কথা। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামনে যে বিষয় রেখেই আলোচনার কথা বলা হোক না কেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মাথায় এখন বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন। নতুন মার্কিন ভিসা নীতির পর এই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে।

এদিকে নির্বাচনকালীন সরকারও এখন আলোচনায়৷ আইনমন্ত্রী এ সপ্তাহেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আগে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কথা বলে তা কয়েক ঘণ্টা পর প্রত্যাহার করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ” নির্বাচনকালীন সরকার সংসদে যে রাজনৈতক দলগুলো আছে, তাদের নিয়ে হতে পারে। কিন্তু বিএনপি যেহেতু সংসদে নাই, তাই তাদের সে সুযোগ নাই।”

আর বিএনপি এখনো এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অবস্থানে অনড় আছে। তারা চাইছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের দাবিতে অনড় আছি। আমাদের আন্দোলন চলবে। আওয়ামী লীগ নেতারা কে কী বললেন তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমু সাহেব যা বললেন তা আবার ওবায়দুল কাদের সাহেব প্রত্যাখ্যান করলেন। সেদিন আইনমন্ত্রী এক কথা বলে তা আবার প্রত্যাহার করলেন। আমার মনে হয় সরকারের ভিতরে চরম অশান্তি, উদ্বেগ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। যে কোনো কারণেই হোক। এই সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আমরা অনড় আছি।”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন,”মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে আমাদের দলের মহাসচিবের কী আলোচনা হয়েছে তা তিনি আমাদের এখনো জানাননি। তবে নির্বাচন নিয়ে আামাদেরা অবস্থান একই আছে।”

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, “সরকারের মধ্যে কোনো উদ্বেগ-উৎকন্ঠা নাই। আমরা মনে করি, বিএনপির আর আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন নেই। মার্কিন ভিসা নীতির পর এটা পরিস্কার যে তারা যা চাইছে তা-ই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে সমর্থন দিয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত। আর সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হবে। এটা মেনে নিয়ে যারা নির্বাচনে আসবেন, তাদের সবার সঙ্গেই সরকারের আলাপ হতে পারে।”

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “না, এই তৎপরতায় আমরা কোনো চাপে নেই। বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা অনেক সময় অনেক কথা বলছেন। অনেক সময়ই তাদের এইসব কথা কাঙ্খিত নয়। তারপরও সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য তারা কোনো ভালো কথা বললে আমরা দেখবো। বাংলাদেশ চলে এখানকার সংবিধান ও আইন অনুযায়ী। সেটা মনে রাখতে হবে সবাইকে। ফলে বিদেশিদের খুব একটা দৌড়ঝাঁপের প্রয়োজন নেই।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ” আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাদের পরস্পরের মধ্যে ইনফর্মেশন গ্যাপ আছে। তাই আমরা তাদের পরস্পরবিরোধী কথা শুনছি।”

তার কথা, “মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দৌড়াদৌড়ি যে বেড়েছে, তা তো আমরা দেখছি। এটা নিয়ে সরকারে অস্বস্তি আছে। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো প্রস্তুতি পর্বে আছে। যে যার দম পরীক্ষা করছে। নির্বাচনের আগে দর কষাকষি আরো বাড়বে। ২০১৪ সালের মতো অবস্থায় কোনো দলই আসলে নেই। আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত ছাড় দেয়ার ঘটনা ঘটবে। এখন দুই দলের যে অনঢ় অবস্থান মনে হয় তা থাকবে না।”

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, “রাজনীতিতে এখন ধোঁয়াশা চলছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই বড় দুইটি রাজনৈতিক দলই এখনো এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে আছে। তারা হয়ত এখনো দেখতে চাইছে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। শাসক দলের নেতারা নানা ধরনের কথা বলছেন। যার পরস্পর বিরোধী। বিএনপি তার অবস্থানে অনঢ় আছে। ফলে এই সময়ে কোনো সমঝোতার পরিবেশ দেখা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি বুঝতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে। হয়ত কোরবানির ঈদের পর পরিষ্কার হতে পারে।”

তার কথা, “মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা তো চোখেই দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে, তা বোঝাই যায়। তবে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো বিদেশি গোষ্ঠীর মধ্যস্থতায় এই রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করা আমাদের জন্য লজ্জাকর ও দুঃখজনক। আমাদের সমস্যার সমাধান আমরা যদি করতে না পারি তাহলে এর চেয়ে লজ্জার কী আছে! এর আগেও আমরা এটা দেখেছি। তাতে যে তেমন সমাধান হয় তা নয়। এবার হলে হতেও পারে।”

এসএইচ-০১/০৯/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)