খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা কঠিন দরিদ্র মানুষের; বেকায়দায় মধ্যবিত্তরা

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে দরিদ্র মানুষের; বেকায়দায় মধ্যবিত্তও। জীবনযাত্রার প্রতিটি পর্যায়ে খরচ বাড়ছে হু হু করে। বাজারে জিনিসপত্রের দামে আগুন। পরিবহন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ খরচ বেড়েছে অন্যান্য খাতেও। কিন্তু আয় সেভাবে বাড়েনি। ফলে এলোমেলো হয়ে পড়া সংসারের বাজেটে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ; কাঁচি চালাতে হচ্ছে মৌলিক চাহিদায়। তাতেও যারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, তাদের কারো সঞ্চয় ভাঙা পড়ছে, কারো বাড়ছে ঋণের বোঝা।

এমন পরিস্থিতির কারণে সবার নজর স্বাভাবিকভাবেই ছিল নতুন বছরের বাজেটে। অনেকের প্রত্যাশা ছিল, কষ্টে থাকা মানুষের দীর্ঘশ^াসের ব্যাপ্তি হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু বাজেটে দরিদ্রদের সহায়তায় বরাদ্দ এখনো অপ্রতুল। দেশের প্রায় চার কোটি মধ্যবিত্তের জন্যও রাখা হয়নি তেমন কোনো সুবিধা।

সরকারি হিসাবে মানুষের মজুরি কিছুটা বেড়েছে; তবে মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত মে মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি রেকর্ড গড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে। অপরদিকে একই মাসে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বাড়তি আয় দিয়ে এখন আর বাড়তি ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না।

ঢাকার বাসাবো এলাকার বাসিন্দা কৌশিক আহমেদ (ছদ্মনাম)। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে প্রতি মাসে পান ৩৫ হাজার টাকা। মাসে ১১ হাজার টাকা বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ বিল দেড় হাজার টাকা, অফিস যাতায়াতে ৫ হাজার টাকা খরচের পর বাজার খরচ সামাল দিতেই হাতটান পড়ে যায় তার। তার ওপর এক সন্তানের স্কুল, শিক্ষাসামগ্রী, প্রাইভেট টিউটরবাবদ অন্তত চার হাজার টাকা যায়। আরেক শিশুসন্তানের খাদ্যের পেছনে যায় দুই হাজার টাকা। ইন্টারনেট বিল ৫০০ টাকা। সবমিলিয়ে মাসে তার ন্যূনতম ৪৪ হাজার টাকা খরচ। অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের ঘাটতি তার ৯ হাজার টাকা। বাড়তি এ টাকার জন্য ঋণ করতে হচ্ছে তাকে।

কৌশিক বলেন, ‘যেভাবে খরচ বেড়ে চলেছে সেভাবে বেতন বাড়ছে না। তার ওপর বাজারের আজকে এক চেহারা তো কাল আরেক। আজ ব্রয়লার মুরগির দামে আগুন, কাল পেঁয়াজের দ্বিগুণ দাম, পরশু ভোজ্যতেলে। এভাবে চললে খরচের হিসাব রাখাও তো মুশকিল। মাস শেষে বেতনের পরিবর্তন হয় না, কিন্তু প্রতি মাসে খরচ বিভিন্ন দিক থেকে বেড়ে যাচ্ছে। পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, বিনোদন, বিলাসী পণ্য- এসব বাদ দিয়েছি অনেক আগে। তারপরও প্রতি মাসে ঋণ করতে হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ টাকা দেনায় আছি।’

বেসরকারি চাকরিজীবী কৌশিকের মতো অটোরিকশাচালক কাশেম মোল্লাও সংসারের বাজেট মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। রাজধানীর কদমতলী এলাকার এ বাসিন্দা অটোরিকশা চালিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার মতো আয় করেন। এ টাকায় রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তিনি জানান, গত জানুয়ারিতে বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা বেড়েছে, গ্যাসের সিলিন্ডারের পেছনে খরচ বেড়েছে, মেয়ের স্কুলের বেতন ১০০ টাকা বেড়েছে, শিক্ষাসমগ্রীর দামটাও বেড়েছে, ছোট বাচ্চার দুধের দামসহ বাজারের খরচ লাগামছাড়া। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ন্যূনতম খরচ ২৫ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ তাকে মাসে ৫ হাজার ৭০০ টাকা ঋণ করতে হয়।

কাশেম বলেন, বছরের ব্যবধানে আয় সামান্যই বেড়েছে। কিন্তু ব্যয় লাগামছাড়া বেড়েছে। পরিবারের খাবার ও পোশাকের পেছনে খরচ অনেক। কাটছাঁট করেও খরচ সামাল দিতে পারছি না। বিয়েশাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলছি। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে

শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পণ্যমূল্য বাড়ছে। তার ওপর আমদানি পণ্যের পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজারও চলে গেছে সিন্ডিকেটের কব্জায়। বিভিন্ন পণ্যের দাম রাতারাতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য ও বাজার চিত্র বলছে, চিনি, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, অ্যাংকর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ মশলা পণ্য, দুধ, ডিম, গরু ও মুরগির মাংস এবং মাছের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। সামান্য লবণের দামটাও বেড়েছে। অপরদিকে বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তেল, সাবান, টুথপেস্ট, টিস্যু, ডিটারজেন্টসহ দৈনন্দিন যাবতীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। লেখার কাগজ, কলমসহ সব ধরনের শিক্ষাসামগ্রীর দামও সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক পরিবারের।

প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী, হাইজেনিক ও টয়লেট সামগ্রীসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যের দাম বাড়তে পারে। একইভাবে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি থালাবাসনসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়তে পারে। বাড়তে পারে টিস্যু, কলম, বিদেশি সাবান, সানগ্লাস, মোবাইল হ্যান্ডসেট, এলপিজি সিলিন্ডার, কাজুবাদম, বাসমতি চাল, প্রক্রিয়াজাত ফল, খেজুরের দামও। অপরদিকে করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম কর দিতে বাধ্য হবেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় যা বলা হয়েছে, সেগুলো আগের নেওয়া পদক্ষেপ। এগুলোর পরেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কীভাবে ৬ শতাংশে কমিয়ে আনা হবে, সে বিষয়ে বাজেটে নতুন কিছু নেই। সামান্য কিছু যা আছে, তা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আছে। মূলত এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কিছু নেই, যা আছে বিশেষ করে বাজেট ঘাটতি ও করের যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও এতে ক্ষতিগ্রস্তদের কীভাবে একটু স্বস্তি দেওয়া যায়, তা ভাবা যেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে নিম্নস্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার কতটুকু সুফল আমরা পাব, তা বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়নি।’

এই বরাদ্দ বণ্টনের ক্ষেত্রে তিন ধরনের সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যারা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসার কথা নয়, সে ধরনের মানুষ এই বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার যারা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা, তারা অন্তর্ভুক্ত হন না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি তহবিল তছরুপ হয়।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির চাপে কষ্ট করছে মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে এটি কমিয়ে আনার কথা বলা হলেও কীভাবে কমানো হবে তা পরিষ্কার হয়নি। আমি মনে করি, এ বাজেটে যে বড় ঘাটতি ধরা হয়েছে, তার অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হবে, তা উল্টো মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেবে।

এসএইচ-০১/১০/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : আমাদের সময়)